সংকুচিত হচ্ছে চাঁদ!

Spread the love

দ্যুতিময় বুলবুল

চাঁদকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের সীমা নেই। কারণ, চাঁদকে নিয়ে নানা মণির নানা মত। তাই বিজ্ঞানীরাও চাঁদকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। ইতোমধ্যে চাঁদে কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ চন্দ্রযানও পাঠিয়েছে। কেউ আবার মানুষও পাঠিয়েছে। ফের সেখানে মানুষ পাঠানোর তোড়জোড় চলছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর কক্ষপথে ১৯৫৭ সালে স্পুৎনিক ১ নামে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছিল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা ২ মিশন হচ্ছে চাঁদে অবতরণকারী মনুষ্যনির্মিত প্রথম বস্তু-যা ১৯৫৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর চাঁদে অবতরণ করে। পরে সোভিয়েত নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন প্রথম মানুষ হিসেবে ১৯৬১ সালে মহাকাশ ভ্রমণ করেন।

এরপর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপোলো ১১ মিশনে মানুষ চাঁদে প্রথম সফলভাবে অবতরণ করেছিল। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই ১০:৫৬ পিএম EDT (স্থানাংকিত আন্তর্জাতিক সময় বা ইউটিসি (ইউটিসি) সময় অনুযায়ী ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই ০২:৫৬) মার্কিন মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং ও এডউইন অ্যালড্রিন চাঁদের মাটিতে পা রাখেন। নীল আর্মস্ট্রং প্রথম চাঁদে পা রাখেন।

আর্মস্ট্রং সিঁড়ি দিয়ে চাঁদে নামতে নামতে মইয়ের নীচে বলেছিলেন, “আমি এখন এলএম [চন্দ্র মডিউল] সরিয়ে নেব”। তিনি তাঁর বাম পায়ের বুটটি চন্দ্র পৃষ্ঠের উপরে প্রথম স্থাপন করেন ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই। তারপর বলেন, “এটি [একটি] মানুষের পক্ষে একটি ছোট পদক্ষেপ, মানবজাতির জন্য একটি বিশাল অগ্রযাত্রা।”

আর্মস্ট্রং যখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন ভয়েস অফ আমেরিকা, বিবিসি এবং বিশ্বব্যাপী আরো অনেক সম্প্রচার মাধ্যম সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। আনুমানিক ৫৩০ মিলিয়ন মানুষ এই ইভেন্টটি দেখেছিল, যা ছিল তৎকালিন সময়ে বিশ্বের প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ২০ শতাংশ।

তবে আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদে প্রথম পদক্ষেপের সঠিক সময়টি অস্পষ্ট। তাঁর প্রায় ১৯ মিনিটের পর, অলড্রিন আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। ফলে এডউইন অলড্রিন চাঁদে হাঁটা দ্বিতীয় মানুষ।

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা অ্যাপোলো কর্মসূচীর মাধ্যমে ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে অন্তত ছয়টি মিশনের মাধ্যমে প্রায় এক ডজন অভিযাত্রীকে চাঁদে পাঠিয়েছিল। এছাড়াও অসংখ্যবার মনুষ্যবিহীন চন্দ্রযানের অবতরণ ঘটে।

এরপর অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে চন্দ্র অভিযান অনেকটা আড়ালেই চলে গিয়েছিল। ভারতের চন্দ্রযান-৩ মিশনের দক্ষিণ মেরুতে সফল অবতরণের পর থেকে, ওই অঞ্চল ঘিরে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ বেড়েছে।

তবে চন্দ্র অভিযানের ৪৭ বছর পর, ২০২৩ সালের ২০ আগস্ট জানা যায়, আগের দিন ১৯ আগস্ট রাশিয়ার চাঁদে পানি খুঁজতে মহাকাশযান পাঠানোর প্রথম অভিযান ব্যর্থ হয়। রুশ মহাকাশযান লুনা ২৫ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চাঁদের বুকে ভূপাতিত হয়।

মূলত গত বছর ২০২৩ সালে ভারতের চন্দ্রযান চাঁদের বুকে সফলভাবে অবতরণের পর, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অভিযানের বিষয়ে নতুন করে আগ্রহ দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়া। যদিও এই তিনটি দেশ এরইমধ্যে চাঁদে তাদের যান পাঠিয়েছে। তবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ভারতের আগে কেউ পৌঁছাতে পারেনি। এমন অবস্থায় অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, দ্বিতীয় মহাকাশ প্রতিযোগিতা বা সেকেন্ড স্পেস রেস শুরু হতে যাচ্ছে কিনা।

ইতোমধ্যে নাসার আর্টেমিস-৩ মিশন ওই অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই মিশনের মাধ্যমে ২০২৬ সালে চন্দ্রপৃষ্ঠে নভোচারী পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে নাসার। চীনের পক্ষ থেকে সেখানে ভবিষ্যতে মানববসতি গড়ার পরিকল্পনার কথাও বলা হয়।

কিন্তু সম্প্রতি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত কয়েকশ’ মিলিয়ন বছর ধরে চাঁদের আকারে নীরবে পরিবর্তন হচ্ছে। উল্লেখযোগ্যভাবে সঙ্কুচিত হচ্ছে চাঁদ।

চলতি বছর ২০২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি নাসার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে চাঁদের কোর ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ায়, চাঁদের পরিধি ১৫০ ফুটেরও বেশি সঙ্কুচিত হয়েছে। এই ক্রমাগত সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে চ্যুতি তৈরি হয়, যা চন্দ্রকম্প সৃষ্টি করে। পৃথিবীতে যেমন ভূমিকম্প ঘটে, তেমনি চাঁদে ‘মুনকম্প’ বা চন্দ্রকম্প হয়, যা ঘন্টার পর ঘন্টা স্থায়ী হতে পারে, পাশাপাশি ভূমিধসও হতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, এটি মানব অনুসন্ধানকে কঠিন করে তুলবে, ঠিক যেমন এটি পৃথিবীতে ফল্ট লাইনের কাছাকাছি বসবাসকারীদের জন্য করে। নাসা, স্মিথসোনিয়ান, অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এই গবেষণা চালিয়েছেন।

এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রমাণ হাজির করেছেন যে, অব্যাহত সংকোচনের ফলে চন্দ্র দক্ষিণ মেরুর চারপাশে কিছু পৃষ্ঠের পরিবর্তন ঘটেছে। এই মেরুতে নাসার ক্রু আর্টেমিস তৃতীয় মিশনের সময় অবতরণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার অর্থায়নে এই নতুন গবেষণায় জানা গেছে, চাঁদের কোর শীতল ও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আর এই কারণে, চন্দ্রপৃষ্ঠে আরও বেশি ভাঁজ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সেখানে ভূকম্পন ও ভূমিধস বেড়েছে। তাই ভবিষ্যতে চাঁদে নভোচারীরা কোথায় অবতরণ করবেন, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবতে হবে।

এতদিন ধারণা করা হচ্ছিল যে, চাঁদের দক্ষিণ মেরুর একটি অঞ্চলে বরফ থাকতে পারে। তাই ওই অঞ্চল ঘিরে বিশ্বের প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা চন্দ্রাভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখছেন, ওই অঞ্চলকে যতটা বাসযোগ্য মনে করা হচ্ছিল, পরিস্থিতি ততটা অনুকূল নয়।

নাসার নতুন গবেষণার ফলাফল দেখে, এই চন্দ্রাভিযান নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। চাঁদের কোর বা কেন্দ্রভাগ ধীরে ধীরে সংকুচিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে অনেকটাই আঙুরের কিশমিশে পরিণত হওয়ার মতো। কোর সংকুচিত হয়ে ঘন ঘন চন্দ্রকম্প হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া কৃত্রিম উপগ্রহপৃষ্ঠের সাধারণ প্রক্রিয়ার মতোই। কৃত্রিম উপগ্রহের দক্ষিণ মেরু সাধারণত কম্পনপ্রবণ এলাকা। এতে ভবিষ্যতে মানববসতি ও যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলে, তা হবে ঝুঁকিপূর্ণ!

ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম সেন্টার ফর আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি স্টাডিজের একজন সিনিয়র বিজ্ঞানী ইমেরিটাস ও গবেষণা প্রবন্ধের প্রধান লেখক টমাস আর ওয়াটার্স বলেছেন, তিনি এই গবেষণার মাধ্যমে কাউকে সতর্ক বা চাঁদের দক্ষিণ মেরুর ওই অংশের অনুসন্ধানকে নিরুৎসাহিত করছেন না। তবে তিনি বলছেন, চন্দ্রপৃষ্ঠ একেবারে অনুকূল জায়গা নয়। সেখানে কিছুই ঘটছে না—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।

গবেষকদের মতে, কয়েক লাখ বছর ধরে ১৫০ ফুট সংকুচিত হয়েছে। এ পরিবর্তন ভূতাত্ত্বিক দিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা পৃথিবীতে ঢেউয়ের প্রভাব বা জোয়ারের চক্রের পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে খুবই সামান্য। কিন্তু চন্দ্রপৃষ্ঠের বিবেচনায় তা অনেক বড় কিছু। সূত্র: সিএনএন, এনডিটিভি, বিবিসি, ইন্টারনেট।

দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।