একটি ত্রিভুজ প্রেমের দম্পতির জবানবন্দী

Spread the love

দ্যুতিময় বুলবুল
নবম পর্ব
একথা সত্য, সংসারে ভালোবাসা ও বিশ্বাসটাই হলো আসল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা না থাকলে সেই সংসার টেকানো বড় কঠিন। পাশাপাশি অভিযোগ জিইয়ে রেখে, অভিযোগের পর অভিযোগের পাহাড় গড়ে, সংসারে সুখ শান্তি বজায় রাখা যায় না। সে ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমঝোতা ও আলোচনার ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

স্ত্রী-সন্তান থাকা সত্ত্বেও, সোমেনের হারিয়ে যাওয়া প্রেমের পুনর্জন্ম অশান্তির আগুন জ্বালানো ছাড়া আর কিছুই নয়। এই আগুন জ্বলে মনে। বনের আগুন দেখা যায়, মনের আগুন দেখা যায় না। সেই আগুন ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস-ভালোবাসা, সম্মান-শ্রদ্ধা সবকিছু পুড়ে ছারখার করে দেয়।

প্রত্যেক সম্পর্কের ভিত তৈরি হয় বিশ্বাস ও ভালোবাসা দিয়ে। এই বিশ্বাসের ভিতটাই যদি দুর্বল হয়ে যায়, তবে সেই সম্পর্কের অস্তিত্ব কী থাকে? আজ আমার ঠিক সেরকম অবস্থা। অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে প্রেম ও বিয়ের পর সংসার শুরু করেছিলাম। সোমেনের ওপর অনেক ভালোবাসা, বিশ্বাস ও ভরসা ছিল। কিন্তু আজ ২১ বছর পর, সব ওলট-পালট হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছি না এখন আমার কী করা উচিত।

আমার সাজানো সংসারে তীব্র কালবৈশাখী ঝড় আঘাত হেনেছে। চারিদিক অমানিশার ঘোর অন্ধকার। অথচ আমাদের বিবাহিত জীবনে কোনো সমস্যা ছিল না। খুব সুখেই ছিলাম আমরা। মনে মনে গর্ববোধ করতাম এই ভেবে যে, আমার মতো সুখী ক’জন আছে? কত মানুষের দাম্পত্য জীবনে সমস্যা। অথচ আমার ও সোমেনের মধ্য়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অধিক ভালোবাসা ও বিশ্বাসের কারণে বুঝতে পারিনি ইতোমধ্যে আমাদের প্রেম ও দাম্পত্য সম্পর্কের ভিত নড়ে গেছে, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ভিতে ঘুণ ধরেছে।

আমি যখন জানতে পারলাম, আমাকে লুকিয়ে দিনের পর দিন অন্য এক নারীর সঙ্গে প্রেম করছে সোমেন। আমি একদম বিশ্বাস করিনি। তবে সংশয় মুক্ত ছিলাম না। আজ জানার পর বুঝলাম, পৃথিবীতে সম্ভব-অসম্ভবের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বিশ্বাস এবং ভালোবাসার কোনো স্থায়ীত্ব নেই। মানুষ গিরগিটির মতো রঙ বদলায়। কার সময় কখন বদলে যাবে, কেউ বলতে পারে না। শ্রী রামচন্দ্রের যে রাতে রাজা হওয়ার কথা ছিল। তার আগেই তাকে সকালবেলা বনবাসে যেতে হয়েছিল।

আজ আমার মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে কখন কী হয় এবং কে কখন কার, এটা বুঝা সবচে’ কঠিন! মানুষের জীবন বহতা নদীর মতো। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ এবং ভালো-মন্দের মিশেলে এগিয়ে চলে জীবন। এই বিচিত্র জীবনের বন্ধুর পথে একা হেঁটে যাওয়া খুব কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। কিন্তু কারো হাত ধরে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর, সেই হাত ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে একা বাকি পথ পাড়ি দেওয়া খুব কঠিন।

তবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, এই পৃথিবীতে কেউ কারো নয়। এমনকি নিজের শরীরটাও পর্যন্ত নিজের নয়। শরীর যদি নিজের হতো তাহলে, যখন শরীর খারাপ হয় তখন নিজেকে জিজ্ঞাসা করে খারাপ হতো। এমনকী, শরীর যখন চলে যায় তখনো জানতে পারি না আমরা। তাহলে কারো ওপর ভরসা বা নির্ভরশীলতার কী আছে?

মানুষের জীবন তো একটাই। অথচ এই এক জীবনে কত কিছুই না ঘটে। জীবনের একেকটা মুহূর্ত একেকরকম। কখনো অনেক কষ্ট বরফের মতো বুকে জমাট বাঁধে। জীবনটা তখন বড় অসহ্য মনে হয়। জীবন যেন তখন মূল্যহীন হয়ে দাঁড়ায়। আবার কখনো জীবন ভরে যায় অপরিমেয় সুখ আর অনাবিল আনন্দে; তখন মনে হয় জীবন বড় সুন্দর, বড় মধুর। এ জীবন কেন দ্রুত ফুরিয়ে যায়?

মানব জীবন সত্যিই বড় বিচিত্র। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ বেশ জটিল। কার জীবনে কখন কীভাবে কী ঘটবে, সেটা কেউ বলতে পারে না। সব সময় যোগ্যতা দক্ষতা অভিজ্ঞতা আর প্রেম ভালোবাসা দিয়ে জীবনে সবকিছু অর্জন সম্ভব নয়। চেষ্টা করলেও মানুষ সব কিছু অর্জন করতে পারে না। তারপরও মানুষ চেষ্টা করে টিকে থাকার, সব গ্লানিকে পাশ কাটিয়ে চেষ্টা করে বেঁচে থাকার।

কালের যাত্রায় ভেসে চলা নদীর স্রোতে যেমন জলের ধারা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়, তেমনি মানুষের জীবন স্রোতে তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যাণ-ধারণা, ভালোলাগা-ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্খা, লাভ-ক্ষতি, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, হিসাব-নিকাশ সবই বদলে যায়। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র, বড়ই বিস্ময়কর, এই জীবনে কেও কোনো দিনই বলতে পারবে না যে, সে মানুষের মন বুঝে গেছে। কখন কার মনে কী ভাবের উদয় হয় তা কেউ বলতে পারে না।

তাই তো জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, ‘মানুষের মন বিচিত্র জিনিস। সমস্ত নক্ষত্র পূঞ্জে যে জটিলতা ও রহস্য তার থেকেও রহস্যময় মানুষের মন’। কে, কখন, কার কতটা আপন শুধু সময় তা বলে দিতে পারে।

অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাঁর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকে দ্বিতীয় অংকের প্রথম দৃশ্যে লিখেছেন, “মানুষ মরে গেলে পচে যায়। বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে অকারণে বদলায়। সকালে বিকালে বদলায়।” মানুষ যখন বদলে যায়, পরিবেশ পরিস্থিতিও তখন বদলে যায়। মানুষ আসলে জলের মতো। পাত্রের মতো আকার ও রঙ বদলায়। তাই কাউকে অন্ধের মতো ভালোবাসার চেয়ে বড় ভুল পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই! (চলবে)

দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।