সৌরজগতের বাইরে দূরবর্তী গ্রহে গভীর সমুদ্র!

Spread the love

২০২২ সালেও দুটি জলের গ্রহের সন্ধান মিলেছে
দ্যুতিময় বুলবুল

সৌরজগতের বাইরে এমন একটি দূরবর্তী গ্রহের (এক্সোপ্লানেট) সন্ধান পাওয়া গেছে, সেখানে গভীর সমুদ্র থাকতে পারে বলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক এই দাবি করেছেন। তাঁরা আশা করছেন যে, সমুদ্র আচ্ছাদিত এই এক্সোপ্লানেটটির সন্ধান তাঁদের পৃথিবীর বাইরে বাসযোগ্য কোনো স্থান অনুসন্ধানের প্রচেষ্টাকে আরও এগিয়ে নেবে । দীর্ঘদিন ধরেই পৃথিবীর বাইরে বাসযোগ্য স্থানের খোঁজ করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। উল্লেখ্য, আমাদের সৌরজগতের বাইরে ভিন্ন কোনো নক্ষত্রকে ঘিরে চক্কর দেয় এমন সব গ্রহকে এক নামে চিহ্নিত করতে ‘এক্সোপ্লানেট’ শব্দটি ব্যবহার করেন গবেষকরা। গতকাল ০৮ মার্চ শুক্রবার ২০২৪, যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই খবর জানানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটেনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহার করে এই নতুন তথ্য হাজির করেছেন। তাদের পর্যবেক্ষণে দাবি করা হয়েছে যে, আমাদের এই সৌরজগতের বাইরে অনেক দূরে অবস্থিত ওই এক্সোপ্লানেটটির বায়ুমণ্ডলে পানির বাষ্প, মিথেন ও কার্বন ডাই–অক্সাইডের রাসায়নিক নমুনা পাওয়া গেছে।

ব্রিটেনের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, টিওআই–২৭০ ডি নামের এক্সোপ্লানেটটির আকার আমাদের এই পৃথিবীর ব্যাসার্ধের দ্বিগুণ এবং এটি পৃথিবী থেকে ৭০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।

যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষকরা দাবি করছেন যে, তাঁরা যে রাসায়নিকের মিশ্রণ পর্যবেক্ষণ করেছেন, তা পানির এক দুনিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেখানে রয়েছে হাইড্রোজেনসমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল আর গ্রহজুড়ে বিশাল এক সমুদ্র।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তথ্য বিশ্লেষণের নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক নিক্কু মধুসূদন বলেন, ‘ওই গ্রহের সমুদ্রের যে পানি, তা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়েও বেশি উষ্ণ হতে পারে। বায়ুমণ্ডলীয় চাপ অনেক বেশি থাকায় এই মহাসাগর তরল অবস্থায় বিরাজ করতে পারে।’ তবে ওই গ্রহ বসবাসযোগ্য কি না, তিনি তা এখনো নিশ্চিত করতে পারছেন না।

অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স লেটারস জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দাবির পক্ষে সমর্থন জানানো হয়েছে। তবে কানাডার একদল বিজ্ঞানী এই এক্সোপ্লানেটটি নিয়ে নানাভাবে পর্যবেক্ষণ করে ব্রিটেনের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। কানাডার বিজ্ঞানীরা এক্সোপ্লানেটটির বায়ুমণ্ডলে একই রাসায়নিক থাকার কথা স্বীকার করলেও, তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, তরল পানির জন্য ওই এক্সোপ্লানেটটি যেহেতু অনেক বেশি উষ্ণ তাই এক্সোপ্লানেটটির পৃষ্ঠদেশ পাথুরে হতে পারে। ফলে এক্সোপ্লানেটটির বায়ুমণ্ডলে ঘন হাইড্রোজেন ও পানির বাষ্প থাকতে পারে।

তবে ব্রিটেন বা কানাডার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে যার মতটিই প্রাধান্য পাক না কেন, সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ থেকে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের অত্যাশ্চর্য অন্তর্দৃষ্টির বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ গ্রহের বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে ফিল্টার করা নক্ষত্রপুঞ্জের আলোকে ধারণ করতে এবং ওই আলোকরাশির মধ্যে নিহিত রাসায়নিক উপাদানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা, কানাডীয় মহাকাশ সংস্থা ও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার যৌথ উদ্যোগে নির্মিত মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটি মহাকাশে প্রেরণ করা হয়েছে। হাবল মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রটির উত্তরসূরী এই টেলিস্কোপটি বর্তমানেপৃথিবী থেকে ১০ লাখ মাইল দূরে অবস্থান করছে। ২০২২ সালের ১১ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই টেলিস্কোপে ধারণ করা প্রথম পূর্ণাঙ্গ রঙিন ছবি প্রকাশ করেন। সম্প্রতি ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা মহাবিশ্বের ১৩৫০ কোটি বছর আগের প্রথম সম্পূর্ণ রঙিন ছবি প্রকাশ করেছে নাসা। এযাবত এটাই মহাজগতের প্রাচীনতম অবস্থার সবচেয়ে স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে তোলা চিত্র।


এর আগে, গত ২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (NASA) বিজ্ঞানীরা কেপলার স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে আমাদের সৌরজগতের বাইরে আটটি নতুন গ্রহ শনাক্ত করেছেন। এসব গ্রহের মধ্যে দুটির গঠন-বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায় বলে নাসার মহাকাশ বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন। এই মহাকাশ গবেষকরা ধারণা করছেন, ওই গ্রহ দুটিতে জলের কোনো অভাব নেই। শুধু তাই না, বলা যেতে পারে জলের ‘এক অনন্য জগত ‘ রয়েছে ওই দুই গ্রহে। ফলে আমাদের এই সৌরজগতের বাইরে ‘পানির চাদরে ঢাকা’এই দুই নতুন গ্রহ মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করে।

মহাবিশ্বে আমাদের সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ এই পৃথিবীর বাইরে আর কোথাও পানির অস্তিত্ব আছে কিনা তার অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছিলেন। কিন্তু তাঁরা তত্ত্বীয় ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, তথ্যপ্রমাণ দিয়ে নিশ্চিত করতে পারেননি।

তবে ২০২২ সালের মধ্য ডিসেম্বরেই প্রথম বিজ্ঞানীরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ‘পানি রয়েছে এমন গ্রহ’ আবিষ্কারের দাবি করেন। তাঁরা এই প্রথম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পৃথিবী ছাড়া ভিন্ন কোনো ‘জলের জগৎ’ আবিষ্কারের দাবি করলেন। ২৯২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার অ্যাস্ট্রোনমিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষকরা লিখেছেন, একটি লাল বামন নক্ষত্রকে আবর্তন করছে কেপলার-১৩৮সি ও কেপলার-১৩৮ডি নামের গ্রহ দুটি। আমাদের সৌরজগৎ থেকে প্রায় ২১৪ আলোকবর্ষ দূরের এক সৌরজগতে এই গ্রহ দুটির অবস্থান। আকারে পৃথিবীর দেড় গুণ বড় হলেও গ্রহ দুটির ভর পৃথিবীর প্রায় দ্বিগুণ। গ্রহ দুটি আবিষ্কারে ভূমিকা রেখেছে নাসার হাবল আর অবসের থাকা স্পিটজার টেলিস্কোপ। আকার ও ভরের এই হিসেবের কারণেই গ্রহ দুটির গল্প কিছুটা জটিল হয়ে উঠেছে।

নতুন আবিষ্কৃত আটটি গ্রহের মধ্যে এই দুটি গ্রহের পৃষ্ঠতল কঠিন এবং পাথুরে। আর তাদের অবস্থানও নিকটতম নক্ষত্র থেকে ততটাই দূরে, যতটা হলে পরিবেশ খুব বেশি গরম বা খুব বেশি ঠান্ডা না হয় এবং তরল জলের প্রাপ্যতা এবং প্রাণের উপস্থিতি থাকার সম্ভাবনা বাড়ে।

প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট সিনেট লিখেছে, অনলাইন ‘এক্সোপ্লানেট’ তালিকাতে নাসা এখনো কেপলার-১৩৮ডি’কে ‘সম্ভবত পাথুরে গ্রহ’ হিসাবে তালিকাভুক্ত করে রেখেছে। নেচার অ্যাস্ট্রোনমিতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের সহ-লেখক, ইউনিভার্সিটি অব মন্ট্রিয়ালের অধ্যাপক বিয়র্ন বেনেকি বলেন, ‘আমাদের আগের ধারণা ছিল যে পৃথিবীর চেয়ে আকারে কিছুটা বড় গ্রহগুলো আদতে পাথর আর বড় আকারের ধাতব বল ছাড়া কিছু নয়। এ কারণেই ওই গ্রহগুলোকে আমরা ‘সুপার আর্থ’ বলে ডাকতাম। আমরা এবার প্রমাণ দেখিয়েছি যে ওই গ্রহ দুটি (কেপলার-১৩৮সি ও কেপলার-১৩৮ ডি) অনেকটাই ভিন্ন। গ্রহ দুটির আয়তনের একটা বড় অংশ জুড়ে সম্ভবত পানি।’ তবে, সম্ভবত নীল সাগর নয়, উত্তপ্ত বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়ানো জলীয় বাষ্প ঢেকে রেখেছে গ্রহ দুটিকে।

গবেষক দলের প্রধান এবং ইউনিভার্সিটি অব মন্ট্রিয়ালের ক্যারোলিন পলেট বলেন, ‘কেপলার-১৩৮সি ও কেপলার-১৩৮ডি গ্রহ দুটির বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা সম্ভবত ফুটন্ত পানির চেয়েও বেশি এবং আমরা গ্রহ দুটিতে ঘন জলীয়বাষ্পের স্তর প্রত্যাশা করছি।’

জলীয়বাষ্পের বায়ুমণ্ডলের নিচে তরল পানি থাকার সম্ভাবনাও ফেলে দিচ্ছেন না গবেষকরা। কেপলার ‘কেপলার-১৩৮সি এবং কেপলার-১৩৮ডি জুটিকে তারা তুলনা করছেন বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ ইউরোপা ও শনি গ্রহের উপগ্রহ এনসেলাডাসের সঙ্গে। ওই দুটি উপগ্রহেও পানির অস্তিত্ব আছে বলে মনে করেন মহাকাশ গবেষকরা। তবে ওই দুই উপগ্রহের সঙ্গে কেপলার জুটির পার্থক্য হলো, নিজ নক্ষত্রের অনেক কাছে অবস্থান করছে গ্রহ দুটি।

নাসার কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ গ্রহ দুটিকে চিহ্নিত করেছিল আগেই। কিন্তু এতদিন গ্রহ দুটির বায়ুমণ্ডলের গঠন উপাদান নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি গবেষকরা। সে কাজে সহযোগিতা করেছে নাসার হাবল ও স্পিটজার টেলিস্কোপ।

টেলিস্কোপে সরাসরি নীল রঙের পানি চোখে পড়েনি মহাকাশ বিজ্ঞানীদের। তবে, গ্রহগুলোর আকার ও ভর নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন তারা। সে তথ্য নিয়ে পরীক্ষাগারের মডেলের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, গ্রহ দুটির আয়তনের একটা বড় অংশ গঠিত হয়েছে পাথরের চেয়ে হালকা কিন্তু হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম গ্যাসের চেয়ে ভারি কোনো উপাদান দিয়ে। সে কারণেই গ্রহ দুটিতে পানির অস্তিত্বের কথা ভাবা হচ্ছে।

অধ্যাপক বেনেকি বলেন, “আমাদের যন্ত্রপাতি আর গবেষণা কৌশল যত উন্নত হতে থাকবে, আমরা সম্ভবত তত বেশি কেপলার-১৩৮সি এবং কেপনার১৩৮ ডি-এর মতো জলের জগতের সন্ধান পেতে থাকবো।”