স্টিভ জবস: তথ্য-প্রযুক্তির মহানায়ক

Spread the love

দ্যুতিময় বুলবুল

আজ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ শনিবার, প্রযুক্তি জগতের কিংবদন্তি পুরুষ স্টিভ পল জবস’র ৬৯তম জন্মদিন। ১৯৫৫ সালের এই দিনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সানফ্রান্সিস্কোতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা জোয়ান ক্যারোল ছিলেন একজন আমেরিকান খ্রিস্টান এবং বাবা আব্দুল্লাহ ফাতাহ জান্দালি ছিলেন সিরিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান। তাঁরা ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন এর গ্রাজুয়েট। তাঁদের প্রেমের ফসল স্টিভস জবসের জন্মের পর, এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে এ্যাডাপশন বা দত্তক দেন।

জবসকে এ্যাডাপশন বা দত্তক নেন পল ও ক্লারা জবস নামের এক দম্পতি। এরপর তারা জবসের নাম রাখেন স্টিভেন পল জবস। নাম না রেখেই নবজাতক জবসকে দত্তক দিয়েছিলেন তাঁর বাবা মা। তাই পল এবং ক্লারা জবস তাঁদের পালক পুত্রের নাম রাখেন স্টিভেন ‘পল’ জবস।

ছোটবেলা থেকেই জবস ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমান কিন্তু লেখাপড়ায় তাঁর মনোযোগ ছিল না। তাই তিনি বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালাতেন। ফলে কলেজ থেকে ড্রপ আউট হয়ে ১৯৭৬ সালে এ্যাপল শুরু করেন। আর এই এ্যাপল তাঁকে নিয়ে যায় সাফল্যের শীর্ষে। লাভ করেন প্রযুক্তির নায়কের আসন।

স্টিভ জবস ছিলেন আধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান রূপকার। বিশ্বের তথ্য প্রযুক্তি জগতের মহানায়ক। কম্পিউটার ও প্রযুক্তিকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসার পেছনে যাঁদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাঁদের মধ্যে স্টিভ জবস অন্যতম। তিনি বদলে দিয়েছেন প্রাচীন প্রযুক্তি। তাঁর সৃষ্টি ছিল পৃথিবীকে বদলে দেয়ার এক বৈপ্লবিক মাধ্যম। স্টিভ জবস তাঁর কাজ দিয়ে এক নতুন বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন।

পার্সোনাল কম্পিউটার ( ডেক্সটপ, লেপ্টপ, মোবাইল ইত্যাদি ) জগতের পথিকৃত ও প্রযুক্তির বরপুত্র স্টিভ জবস-ই কম্পিউটার নামক বিস্ময়কর যন্ত্রটি আমাদের সবার হাতে নিয়ে ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছেন। জবস সেই ব্যবস্থা না করলে হয়তো কম্পিউটার শুধু গবেষণাগার ও সরকারি কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। আজকের এই প্রযুক্তি বিপ্লব হতো না। তাই বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রগতিশীল, প্রভাবশালী, প্রতিভাবান ও সফল প্রযুক্তিবিদ হিসেবে স্টিভ জবসের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়।

স্টিভস জবস স্টিভ ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েনকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৭৬ সালে “অ্যাপল কম্পিউটার” প্রতিষ্ঠা করেন। অ্যাপল ইনকরপোরেটেডের সহপ্রতিষ্ঠাতা, উদ্ভাবক, বিনিয়োগকারী স্টিভেন পল জবস’র জীবনের গল্প রূপকথার মতো। একসময় যে তরুণ জবস এক বেলা খাবারের জন্য রাস্তায় কোকের বোতল কুড়াতেন, মৃত্যুর সময় তিনিই রেখে যান ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

২০১১ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, জবসের আনুমানিক সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় এক হাজার দুইশ কোটি মার্কিন ডলার। এই সম্পদের বেশিরভাগই এসেছিল ২০০৬ সালে ওয়াল্ট ডিজনির কাছে পিক্সার স্টুডিও বিক্রয় থেকে। কিন্তু ধারণা করা হয়, জবস যদি ১৯৮৫ সালে এ্যাপল ছাড়ার সময় তাঁর এ্যাপলের সব শেয়ার বিক্রী না করতেন, তবে তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াতো প্রায় তিন হাজার ছয়শ’কোটি মার্কিন ডলার।

স্টিভস জবস’র হাতেই বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাপল ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পিক্সার এনিমেশন। তাঁর হাত ধরেই আসে আইফোন, আইপড ,ম্যাকিন্টোস কম্পিউটার সহ প্রযুক্তি দুনিয়ার সেরা পণ্যগুলো। আর সে কারণেই স্টিভ জবসকে বলা হয় “টেক-টাইটান” এবং এনিমেশন জগতের পথিকৃৎ । তবে নিজের তৈরি প্রতিষ্ঠান থেকে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে লজ্জাজনকভাবে বেরিয়ে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতাও তাঁর আছে। আবার সেই প্রতিষ্ঠানে বীরের মতো ফিরে এসে বিস্ময়কর সাফল্যও দেখিয়েছেন জবস।

আমেরিকান উদ্ভাবক, ডিজাইনার এবং এ্যাপল কম্পিউটারের সহ উদ্যোক্তা,স্টিভেন জবস ছিলেন এ্যাপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং চেয়ারম্যান। এ্যাপল ইনকরপোরেশন এর বিশ্বখ্যাত পণ্য আইপড, আইপ্যাড, আইফোন, আইম্যাককে ধরা হয় বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির শুরুর প্রথম ধাপ হিসেবে। এর সবগুলোর পেছনেই ছিল তাঁর সরাসরি অবদান। তাঁর বিস্ময়কর সৃজনশীলতার জন্য বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং সভ্যতার বিকাশ তরান্মিত হয়েছে।

১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকের কম্পিউটার বিপ্লবের পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয় স্টিভ জবসকে। অ্যাপলের ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার তৈরিতে তাঁর ব্যাপক অবদান ছিল। এই ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার অ্যাপলকে অভাবনীয় সাফল্য এনে দেয়। তারপরও স্টিভেন ১৯৮৫ সালে জবসকে তাঁর নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত প্রিয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এ্যাপল ছাড়তে হয়, অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের “বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের” সদস্যদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে। মূলত তাঁরই নিয়োগকৃত সহকর্মীদের ষড়যন্ত্র ও অসহযোগিতার কারণে তিনি এ্যাপল ইনকর্পোরেশন থেকে পদত্যাগ করেন।

তবে এ্যাপল ছাড়ার পর জবস কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নেক্সট চালু করেন এবং এই নতুন প্রতিষ্ঠানের সিইও এবং চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই নেক্সট কম্পিউটার ব্যবহার করে সুইজারল্যান্ডের জেনেভার সার্ন থেকে পৃথিবীর প্রথম ওয়েবসাইট প্রকাশ করেন ওয়েবের জনক স্যার টিম বার্নার্স-লি।

স্টিভস জবস ১৯৯১ সালের ১৮ মার্চে লরেন পাওয়েলকে প্রেম করে বিয়ে করেন। পাওয়েলের সঙ্গে জবসের সাক্ষাৎ হয় ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে, স্ট্যানফোর্ড বিজনেস স্কুলে। পাওয়েল তখন সেখানে এমবিএ করছিলেন। তাঁদের তিন সন্তানের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আলটোতে তাঁরা বসবাস করতেন।

উল্লেখ্য, জবস’র ২৩ বছর বয়সে প্রেমিকা ক্রিসান ব্রেনানের গর্ভে লিসা নামে তাঁর একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছিল। আদালতে অবশ্য তিনি নিজেকে সন্তান জন্মদানে অক্ষম দাবি করে লিসার পিতৃত্ব অস্বীকার করেছিলেন। জবস লিসার সাত বছর বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনও যোগাযোগ করেননি। তবে লিসা যখন কিশোরী তখন জবস মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে নেন।

বিশ্বখ্যাত অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পিক্সারের প্রতিষ্ঠাতাও স্টিভ জবস। তিনি “পিক্সার এ্যানিমেশন স্টুডিওস”-এরও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। তবে ওয়াল্ট ডিজনি পিক্সার অধিগ্রহণ করার পর, তিনি ডিজনির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হন। তিনি ১৯৯৫ সালে টয় স্টোরি নামের অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন।

১৯৯৬ সালে অ্যাপল কম্পিউটার নেক্সট কম্পিউটারকে কিনে নিলে জবস ১৯৯৭ সালে অ্যাপলে ফিরে আসেন। অ্যাপলে ফিরে স্টিভ জবস আইম্যাক, আইফোন, আইটিউনস মিউজিক স্টোর, আইপড ও আইপ্যাডের মতো যুগান্তকারী প্রযুক্তিপণ্য ও সেবা বাজারে এনে অ্যাপলকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যান।

২০০৩ সালে স্টিভস জবসের অগ্নাশয়ের নিউরোইনডক্রিন টিউমার ধরা পড়ে। দুর্লভ এই ক্যান্সার ছিল অপারেশনযোগ্য। কিন্তু জবস অসুস্থতার খবর গোপন রাখেন দীর্ঘ নয় মাস। তবে ২০০৪ সালে সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জবসের টিউমার অপসারণ করা হয়।

অস্ত্রোপচারে তিনি সুস্থ হলেও, ২০০৯ এর শুরুর দিকে তাঁর ওজনহ্রাস পেতে থাকে। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে জবস ঘোষণা দেন, তিনি অসুস্থকালীন ছুটিতে যাচ্ছেন। অগাস্টে তিনি এ্যাপলের সিইও পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং পাকাপাকি ভাবে টিম কুকের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করেন। এক মাস পর, ২০১১ সালের ৫ অক্টোবর তাঁর দ্বিতীয় দফায় ক্যান্সারে বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে। প্রায় এক দশক অগ্নাশয়ের ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে যুক্তরাষ্ট্রের পালো আলটোতে ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন প্রযুক্তি জগতের এই প্রবাদ পুরুষ।

জবস’র বোন মোনা সিম্পসনের ভাষ্য অনুযায়ী, মৃত্যুর মূহুর্তে জবস তাঁর বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের দিকে তাকিয়ে শেষ বাক্য বলেছিলেন, “OH WOW. OH WOW. OH WOW.” যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়, “চমৎকার! চমৎকার! চমৎকার!” তিনি কেন মৃত্যুর সময় এই কথা বলেছিলেন তার কোনও সঠিক ব্যাখ্যা কারও কাছে নেই।

আধুনিক বিশ্বকে এগিয়ে নেওয়ার এই মহান কারিগর স্টিভস জবসের জীবন ও সৃষ্টিকর্ম অনেকটাই সিনেমার গল্পের মতো। তাই তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনের গল্প নিয়ে অনেক বই ও একাধিক সিনেমা তৈরি হয়েছে।

স্টিভস জবসকে নিয়ে ইতোমধ্যে যে সব বই প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে ২০১১ সালে প্রকাশিত ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখা স্টিভ জবসের জীবনী গ্রন্থটি স্বয়ং জবস অনুমোদিত। জবসের অনুরোধে ‘স্টিভস জবস’ শিরোনামে বইটি লিখেছেন ওয়াল্টার আইজ্যাকসন। তিনি সিএনএন ও টাইম পত্রিকার নির্বাহী ছিলেন এবং বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ও আলবার্ট আইনস্টাইনের জীবনী লিখেছেন।

বইটি ২০১১ সালের ২৪ অক্টোবর জবসের মৃত্যুর ১৯ দিন পর, সিমন অ্যান্ড শুস্টার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়। বইটিতে এ্যাপলের সিইও হিসেবে জবসের উত্তরসূরী টিম কুক এর প্রতারণার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এরপর ২০১২ সালে ক্যারেন ব্লুমিনটাল কিশোর-তরুণদের জন্য জবস’র জীবনী লিখেছেন। ২০১৫ সালে ব্রেন্ট স্লেন্ডার এবং রিক টেটজিল যৌথভাবে ‘বিকামিং স্টিভ জবস’ নামে একটি তথ্যভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছেন।

জবসকে নিয়ে যেসব সিনেমা তৈরি হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ২০১৩ সালে নির্মিত ও অতি সমালোচিত চলচ্চিত্র ‘জবস’। আর ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখা স্টিভ জবসের জীবনী গ্রন্থটি অবলম্বনে ড্যানি বয়েলের পরিচালনায় এবং অ্যারন সরকিনের চিত্রনাট্যে ২০১৫ সালের ৯ অক্টোবর ’স্টিভ জবস’ ছবি মুক্তি পায়। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন মাইকেল ফাসবেন্ডার।

দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।