ভারতবর্ষের মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

Spread the love

দ্যুতিময় বুলবুল

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহানায়ক, বাঙালির চিরদিনের অহংকার ও শৃঙ্খলমুক্তির চেতনার প্রতীক, যিনি ব্রিটিশ ঊপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে সশস্ত্র যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং জাতির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।’ যার এই ঐতিহাসিক ডাক শুনে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্তরের লাখ লাখ নারী পুরুষ জীবনবাজি রেখে দলে দলে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

ভারতবর্ষের যুব সম্প্রদায় যার নামে ছিল পাগল প্রায়। দেশকে পরাধীনতা মুক্ত করতে ইংরজে শাসকের বিরুদ্ধে লড়তে যিনি তাঁর প্রবল সাহসে ভর করে এগিয়ে আসেন এবং সঙ্গে আনেন যুবদের, যিনি ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনি তুলেছিলেন- বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা কেউ দেয় না, ছিনিয়ে নিতে হয়।’

যার স্বপ্নের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আইএনএ-র উল্লেখযোগ্য কমান্ডাররা ছিলেন মহম্মদ জামান কিয়ানি, শাহনওয়াজ খান, প্রেম সাইগল, গুরবক্স সিং ধিলোঁ প্রমুখ, সেই মহান বিপ্লবী মহাবীর, দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজ ১২৮তম জন্মদিন।
এই মহান জননায়ক, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি বর্তমান ওড়িশা রাজ্যের কটক শহরে (ওড়িয়া বাজার) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও মা প্রভাবতী দেবী। ১৪ ভাইবোনের মধ্যে সুভাষ ছিলেন নবম।

অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন সুভাষ। তিনি কটকের স্টিওয়ার্ট স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর কটকেরই রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯১৩ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৪ সালে গরমের ছুটির সময় তিনি ও তাঁর এক বন্ধু গোপনে তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। মন বড় অস্থির। তীর্থযাত্রা, গুরুর সন্ধান ও ভারত পরিভ্রমণের ধরলে বাড়ি ফিরে তিনি টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে তীব্র অসুস্থ হয়ে পড়েন।

ফলে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তাঁর ফল বেশ হতাশজনক হয়। সুভাষের মনে অনুশোচনা আসে। শেষে তিনি মনস্থির করেন, দর্শন-এ অনার্স নিয়ে বি.এ. পড়বেন এবং ভাল ফল করবেন। তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তখন তাঁর বয়স ষোল বছর। ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে সাম্মানিকসহ বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এরপর ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে অসুস্থ অবস্থায় বি.এ. পাশ করেন। এরপর তিনি লন্ডনে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ‘মানসিক ও নীতিবিজ্ঞান’ বিভাগে ট্রাইপোজ’ এর জন্য পড়ার সুযোগ পান। পরে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে চতুর্থ স্থান লাভ করেন।

ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় মহাকৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেও, চাকরিতে যোগ দেননি সুভাষ। কারণ, যে ইংরেজ ঊপনিবেশিক শাসকদের দেশ থেকে তাড়াবেন তিনি, তাদেরই অধীনে চাকুরি করবেন, এটা হতে পারে না। এই বিপ্লবী চেতনায় তিনি সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করেন।

এ প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র নিজেই বলেছেন, ‘কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হলো, সেই সরকার থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আত্মবলিদানের আকাঙ্খা আজই আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে, যা ভারতকে বাঁচিয়ে রাখবে।’

সুভাষচন্দ্র বসু আইসিএস অফিসার না হয়ে, ১৯২১ সালে ভারতে ফিরে রাজনীতিতে যোগ দেন। শপথ নেন যে কোনো মূল্যে ইংরেজদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করবেন। যোগ দিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। তাঁর স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল একইসঙ্গে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শে। তাঁর জীবনে মানবিক চেতনা ও প্রেরণার উৎস ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ তাঁকে ছোট থেকেই অনুপ্রাণিত করেছিল।

অল্পদিনের মধ্যেই সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা হয়ে উঠেছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হলে, তিনি নির্বাহী কর্মকর্তা হন। ১৯২৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৩০ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন।

তারপর সুভাষচন্দ্র বসু দু’বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। মহাত্মা গান্ধী চাননি নেতাজি দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের সভাপতি হন, তাঁর প্রার্থী ছিলেন পট্টভি সীতারামাইয়া। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সুভাষ ছিলেন গান্ধী, নেহরুর বিপরীত মেরুতে। তিনি মনে করতেন গান্ধীজির অহিংসার নীতি ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। স্বাধীনতার জন্য তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করার জন্য তাকে পদত্যাগ করতে হয়।

মাহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতিতে প্রথমে সমর্থন করলেও, এক পর্যায়ে গান্ধীজীর সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের পন্থা নিয়ে বনিবনা না হওয়ায়, সুভাষ কংগ্রেস ছেড়ে দেন। গঠন করেন ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি রাজনৈতিক দল। তারপর ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের পূর্ণ ও সত্বর স্বাধীনতার দাবি জানান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও সুভাষ বসুর বিপ্লবী মতাদর্শের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং এই যুদ্ধকে ব্রিটিশদের দুর্বলতা ভেবে, সুবিধা আদায়ের সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন সুভাষ বসু। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করা হবে না, যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, সুভাষের এই অবস্থান নিয়েও গান্ধীর সঙ্গে মতানৈক্য ছিল সুভাষের।
ভারতবর্ষের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা, কিংবদন্তীর মহান নেতা, সুভাষকে ইংরেজ সরকার ১১ বার কারাবন্দি করেছে। কিন্তু কোনোভাবেই বশে আনতে পারেনি। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে নির্বাসন দণ্ড দিয়েও কাজ হয়নি। জব্দ করা যায়নি বাড়িতে নজরবন্দি করে রেখেও। ছদ্মবেশে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন আন্তর্জাতিক বন্ধুরাষ্ট্রের সন্ধানে, সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশমাতাকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে নেতাজি যখন এলগিন রোডের বাড়িতে গৃহবন্দী। তখন বাড়ির উপর নজর রাখছিলেন অন্তত ১৫ জন ব্রিটিশ গোয়েন্দা। আর সাতটি স্তরে ছিল পুলিশি বেষ্টনী । সেই কড়া নজরদারি ও পাহারা এড়িয়ে ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি নেতাজি ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ি ছেড়ে ছদ্মবেশে বেরিয়ে যান৷

সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে নানা জায়গা ঘুরে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, ইতালির দূতাবাসের সহায়তায় তিনি আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে রাশিয়া, তারপর জার্মানি যান। স্টালিন কিংবা হিটলার, কারোও কাছ থেকেই সন্তোষজনক সাড়া ও সহযোগিতা পাননি। যদিও তিনি জার্মান পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত আজাদ হিন্দ রেডিও’র সম্প্রচারের দায়িত্বে থাকা ভারতের স্পেশাল ব্যুরোর সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি বার্লিনে ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের মধ্য থেকে সৈন্যদের নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠন করেন। কিন্তু ভৌগোলিকভাবে অত দূর থেকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া কঠিন। তাই নেতাজি পূর্ব-এশিয়ায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে জার্মানি থেকে সাবমেরিন করে জাপানে চলে আসেন এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী মহাবীর।

জাপানে অবস্থানরত ভারতবর্ষের আর এক স্বাধীনতা সংগ্রামী, বর্ষিয়ান বিপ্লবী নেতা রাসবিহারী বসু তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। তারপর জাপানের সহযোগিতায় তৈরি আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব রাসবিহারী সুভাষের হাতে তুলে দেন। তরুণ বিপ্লবী সুভাষ আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব নেন। সেইসঙ্গে সবার প্রিয় সুভাষ ‘নেতাজি’ উপাধি লাভ করেন।

এরপর জাপানিদের সহযোগিতায় সুভাষচন্দ্র বসু ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুরদের নিয়ে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ পুনর্গঠন করেন। এ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন সুভাষ। জাপান সরকার সর্বতোভাবেই এই স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতকে সাহায্য করে ব্রিটিশ-শাসনমুক্ত করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু একইসঙ্গে তারা আজাদ হিন্দ বাহিনীকে রাখতে চেয়েছিল আজ্ঞাধীন।

আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করে যুদ্ধের উপযোগী করে গড়ে তোলেন সুভাষ। তারপর তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে জাপানের সহযোগিতায় উত্তর -পূর্ব ভারতের মণিপুর দখল করে সেখানে ভারতের পতাকা উড়িয়ে দেন।

সুভাষচন্দ্র জাপান কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, শুধুমাত্র মিলিটারি কার্যক্রম ভারতের স্বাধীনতার জন্য পর্যাপ্ত নয়৷ আলাদা প্রচার কার্যক্রম দরকার। এজন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা– যাকে ‘অক্ষশক্তি’ স্বীকৃতি দেবে। তাই নেতাজি নতুন স্বাধীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেন।

১৯৪৩-এর ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের ক্যাথে সিনেমা হলে প্রথম ‘স্বাধীন ভারত সরকার’ (Provisional Government of Free India) প্রতিষ্ঠিত হয়। গঠিত হয় পূর্ণ মন্ত্রিসভা। এই সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও স্বশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে প্রথমেই শপথ নেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। এছাড়াও নেতাজি নিজের হাতে রাখেন পররাষ্ট্র ও যুদ্ধবিষয়ক দফতর। সরকারের অর্থমন্ত্রী হন এ সি চট্টোপাধ্যায়, নারীবিষয়ক মন্ত্রী লক্ষ্মী সেহগল, প্রচার ও প্রপাগান্ডা দফতরের প্রধান এস এ আইয়ার৷ এছাড়া এ এন সরকার-সহ আরও ১৫ জন ছিলেন সুভাষের মন্ত্রিসভার সদস্য। বর্ষিয়ান বিপ্লবী নেতা রাসবিহারী বসু মনোনীত হন এই আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।

২১ অক্টোবর রাতেই প্রধানমন্ত্রী সুভাষচন্দ্রের বাসভবনে মন্ত্রিসভার পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে অবিলম্বে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। রাত ১২টার পর, ২২ অক্টোবর প্রথম প্রহরে সিঙ্গাপুর বেতারে প্রথম ভারত সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

একবছর দশ মাস এই স্বাধীন সরকার পরিচালিত হয়। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ও ভারতের মূল ভূখণ্ডের পূর্ব সীমান্ত ছিল এই সরকারের শাসনাধীন ছিল। কিন্তু ১৯৪৫-এর ৬ ও ৯ আগস্ট আমেরিকা হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোম নিক্ষেপের পর, জাপান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ফলে নেতাজির সশস্ত্র যুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়।

তবে ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন ‘স্বাধীন ভারত সরকার’ গঠিত হয়েছিল, তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ইউরোপ ও এশিয়ার ১১টি দেশ। এসব দেশের স্বীকৃতি লাভের পর, প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষ বসুর নেতৃত্বে ভারত সরকার প্রকাশ করেছিল ডাকটিকিট, চালু করেছিল নিজস্ব ডাকব্যবস্থা ও কারেন্সি নোট৷ স্থাপিত হয়েছিল আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক)৷ মুক্ত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে নেতাজি এই দু’টি জায়গার নাম বদল করে রেখেছিলেন ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ দ্বীপ’৷ নিয়োগ করেছিলেন প্রশাসক৷ এই সরকার বিদেশে দূতাবাসও স্থাপন করেছিল।

নেতাজি গঠিত আজাদ হিন্দ সরকারের পতনের পর, তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ মনে করেন, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসু নিহত হয়েছেন। তবে অনেকে এই বিমান দুর্ঘটনা ও নেতাজির মৃত্যু সম্পর্কে আজও সন্দিহান। সেই সময় বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি এই দাবি অনেকেই করেন।

২০০৬ সালে মুখার্জি কমিশন দাবি করেছিল যে, ওই বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। এছাড়াও জাপানের রেনকোজি মন্দিরে রাখা চিতাভষ্ম নেতাজির নয়, এমন দাবিও করা হয়। যদিও ওই বিমানে নেতাজির সহযাত্রী ও তাঁর সহকারী হাবিবুর রহমানসহ জাপানি চিকিৎকরা ওই দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছে বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

তবে নেতাজির মৃত্যু রহস্য নিয়ে আজও বিতর্ক থাকলেও, তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও চেতনা সারা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষকে সব সময় উদ্দীপ্ত করে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধ্রুবতারা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন। বাঙালির এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান পুরো জীবন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে উৎসর্গ করেছেন।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন ও ইংরেজদের ভারত ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পেছনে নেতাজির অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাটলিও স্বীকার করেছেন যে, সুভাষ বোসের জন্যই ব্রিটিশদের তড়িঘড়ি ভারত ছাড়তে হয়। তাই সুভাষের দেশপ্রেম ও জীবন সংগ্রাম সব সময় দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা দেয়।

স্বাধীনতার জন্য ভারতবাসীর প্রতি নেতাজির অমর ও অক্ষয় অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর তাঁর সেই ঐতিহাসিক ডাক, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’ গোটা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য চিরদিনের প্রেরণা, পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির চেতনা।
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।