পরকীয়া না আপনকীয়া
এক ত্রিভুজ প্রেমের দম্পতির জবানবন্দী
দ্যুতিময় বুলবুল
স্বামী সোমেনের পরকীয়া (Extramarital affair) সম্পর্কে হঠাৎ জানতে পেরে, মাথায় যেন বাজ পড়ে যায় শ্যামলীর। যদিও তিনি তা বিশ্বাস করেননি। কারণ, ১৫ বছরের সংসার জীবন তাদের। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন ও পরবর্তী সময় মিলিয়ে ছয় বছরের প্রেম। মোট ২১ বছরের সম্পর্ক। উপরন্ত ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে। তাই শ্যামলী ভাবতেই পারেন না, সোমেন এই মধ্য বয়সে এসে পরকীয়া প্রেম করবে!
কিন্তু অনেক সময় মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। শ্যামলীরও সন্দেহটা সেখানেই। কারণ, মানুষের মন বড় বিচিত্র। কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, “মানুষের মন বিচিত্র জিনিস। সমস্ত নক্ষত্র পূঞ্জে যে জটিলতা ও রহস্য তার থেকেও রহস্যময় মানুষের মন।”
মন নিয়ে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে,“মানুষের মন আকাশের মতো”। কারণ, আকাশের রঙের যেমন কোনো স্থায়িত্ব নেই, কখন কোন অবস্থায় কী রূপ ধারণ করবে, বলা যায় না। তেমনি মানুষের মনও নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে, কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর সারাক্ষণ স্থির থাকে না। সত্যিই মানুষের মন বড়ই বিচিত্র।
তাই যদিও শ্যামলী সোমেনের পরকীয়া প্রেমের খবরটা বিশ্বাস করতে পারছেন না, কিন্তু তাঁর মনও মানছে না। অস্থির হয়ে পড়েছেন তিনি। বুকের মধ্যে খচ খচ করছে। মাথায় কত প্রশ্ন আসছে। কিন্তু জবাব কোথায়? যা শুনেছি, তা কি সত্যি? নাকি মিথ্যা? নিজেকেই প্রশ্ন করেন শ্যামলি।
শ্যামলী ভাবছেন, এখন উত্তরাধুনিক যুগ, নারী-পুরুষ অনেক স্বাধীন, খোলামেলা। মেলামেশাও খুব সহজ, স্বাভাবিক ও অবাধ। তাই শুধু অবিবাহিতা তরুণ-তরুণীদের প্রেম নয়, বিবাহিত নারী-পুরুষেরও পরকীয়া প্রেমের কাহিনি অহরহ শুনি। সোমেনও এমন কাজ করছে না তো? তা না হলে হঠাৎ করে এমন কথা কেউ বলবে কেন? কথায় আছে, “যা রটে, তার কিছু তো বটে!” ভাবতে থাকেন শ্যামলী।
আজকাল প্রায় সোমেনকে খিটমিটে মেজাজে দেখি। সামান্য কিছুতেই রেগে যায়। বাসায় আগে যতটা সময় দিত, এখন দেয় না। ছেলে মেয়ের পড়াশুনায় নজর দিত, এখন সেদিকেও খেয়াল নেই। আগে যেমন সব সময় হাসিখুশি থাকত, এখন সেটাও দেখি না। রান্না নিয়েও এখন প্রায় প্রশ্ন তোলে। কিন্তু আগে যেভাবে-যা রান্না হতো, তাই খেতো। কোনো প্রশ্ন তুলতো না। এখন প্রায়ই বলে আজ তরকারিতে লবণ কম তো, কাল ঝাল বেশি। পরশু তেল কম তো-তরশু হলুদ বেশি। প্রায় প্রতিদিন তার এমন অভিযোগ লেগেই আছে। ১৫ বছর ঘর করার পর, যেন এখন নতুন করে রান্না শিখছি! কেন সোমেন এত বদলে গেল!
অবশ্য সোমেন আগে থেকেই কিছুটা ‘আত্মপ্রেমী’, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে নার্সিসিস্ট (narcissist) বলা হয়! মনে হয় তার আত্মপ্রেম আরও বেড়েছে। এখন সে আমার সব কাজের খুঁত ধরে। সুযোগ পেলেই সমালোচনা করে। নেতিবাচক কথা বলে। আমার চাওয়া-পাওয়া কিম্বা আমার খুশি-অখুশি নিয়ে তেমন ভাবে না। আগে এতটা স্বার্থপর সে ছিল না। তবে নিজের স্বার্থটা সব সময় বড় করে দেখত।
বিয়ের আগে ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষ অনার্স পড়ার সময়, আমাদের প্রেম হয়। তখনও দেখেছি, সে নিজের চাওয়া পাওয়া এবং নিজ মতামতের ওপর বেশি জোর দিত। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপিয়ে দিত। তবে যথেষ্ট রোমান্টিক ছিল সে। প্রতিদিন একসঙ্গে ঘোরাফেরা, টিএসসিতে আড্ডা দেওয়া, মাঝে মধ্যে রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া, প্রতি সপ্তাহে মহিলা সমিতি মঞ্চে নাটক দেখা, সিনেমা হলে গিয়ে মাসে অন্তত দু’টি সিনেমা দেখা, একসঙ্গে ভালো বইপড়া বা বই আদান-প্রদান করা কিংবা কোনো জ্ঞানগর্ভ বিষয়ে আলোচনা-সবই চলতো।
এভাবেই দ্বিতীয় বর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চারটি বছর কাটিয়ে মাস্টার্স শেষ করার পর, আমরা বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। পাশাপাশি আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করলাম। সোমেনের রেজাল্ট বরাবরই ভালো ছিল। তাই দ্রুত সে একটি বিদেশি ব্যাংকে (HSBC) চাকরি পেল। তারপর আমরা বিয়ে করলাম। (চলবে)
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।