দ্বিতীয় পর্ব
একটি ত্রিভুজ প্রেমের দম্পতির জবানবন্দী
দ্যুতিময় বুলবুল
বিদেশি ব্যাংকের চাকরিতে বেতন ও সুযোগ সুবিধা ভালো ছিল। তাই আর বিসিএস পরীক্ষার দিকে এগুলো না সোমেন। কথা ছিল দু’জনেই চাকরি করব। কিন্তু আমাকে সে চাকরি করতে দিলো না। আমার ওপর চাপিয়ে দিলো সংসার। তার যুক্তি, দু’জনেই চাকরি করলে সংসারটা ভালোভাবে করা যাবে না। লিভ টুগেদার (Living together) বা ম্যাচ কিম্বা হোস্টেল জীবনের মতো হবে। সঠিকভাবে সংসার জীবনের দায়-দায়িত্ব পালন করা কঠিন হবে। আবার এমনও হতে পারে চাকরির কারণে দু’জন একসঙ্গে থাকাও যাবে না। ফলে ভবিষ্যতে ছেলে মেয়ের পড়ালেখা ও তাদের মানুষ করা সমস্যা হবে। সোমেনের এসব চিন্তা-ভাবনা আমার কাছে গোঁড়া ও পশ্চাৎপদ মনে হয়েছে। তাই আমার দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও, শেষ পর্যন্ত তার যুক্তিই আমি মেনে নিয়েছি, সংসারে সুখ ও শান্তির প্রত্যাশায়।
বিয়ের পর অফিস থেকে প্রতিদিন অন্তত তিন/চারবার সোমেন ফোন করতো। আমি খেয়েছি কি-না। কী করছি, কেমন আছি, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খোঁজ-খবর নিতো। প্রায়ই বলতো তোমাকে ভীষণ মিস করছি। আমার বেশ ভালোই লাগতো। বিকেলে অফিস থেকে ফিরেই জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে সে বলতো,“I love You My Darling”. আমি ভীষণ খুশি হতাম।
তারপর ফ্রেস হয়ে চা-নাস্তা খেয়ে কখনো একসঙ্গে টিভি দেখা ও গল্প আড্ডা চলতো, আবার কখনো সন্ধ্যায় ধানমন্ডি লেকের ধারে একসঙ্গে হাঁটতে যেতাম আমরা। আর শুক্র ও শনিবার বন্ধের দিন বিকেলে হয় কোথাও বেড়াতে যেতাম অথবা কেনাকাটা, না হলে কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া এবং সিনেমা দেখা ছিল আমাদের রুটিন কাজ।
ফলে ছকে বাঁধা রুটিন জীবনটা ভালোই কাটত। সোমেন চাকরি করছে। আর আমি সংসার চালাচ্ছি। বাচ্চা প্রতিপালন করছি। তাদের পড়াশুনা দেখছি। স্কুলে আনা-নেয়া করছি। এসব নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকছি। নিজের জন্য আলাদা সময় বের করতে চাইলেও পারি না। তবুও মনে হতো বেশ আছি, ভালো আছি। যদিও অনেক সময় হাঁপিয়ে উঠতাম। ভাবতাম, এটা একটা মানবজীবন, নাকি রোবট জীবন। এমন জীবন কি আমি চেয়েছিলাম?
তবে আনন্দও ছিল। কোনো কোনো দিন হয়তো অফিসে কাজের চাপে সোমেন ফোন করার সময় পেতো না। আমারও অনেক bored লাগতো। সে সেটা বুঝতে পারতো। তাই বাসায় ফিরেই সে Sorry করতো। বলতো, শ্যামলী Sorry, আজ তোমাকে একবারও ফোন করতে পারিনি। নিশ্চয়ই তোমার একা একা ঘরে শুয়ে বসে Bore লাগছিল। আমি তাকে শান্ত্বনা দিয়ে বলতাম-না ঠিক আছে, আমি তো সারাক্ষণ ব্যস্তই থাকি। সময় পেলে বই পড়ি, টিভি দেখি, গান শুনি। তাই কোনো অসুবিধা হয় না।
কথা বলতে বলতেই সোমেন জড়িয়ে ধরে চুমু দিতো, আদর করতো। আমার বরফ জমাট মান-অভিমান ভেঙে জল হয়ে গড়িয়ে পড়তো। তারপর কাপড় ছেড়ে ফ্রেস হয়ে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতো সোমেন। আমি সন্ধ্যায় হালকা নাস্তার আয়োজন করতাম। তারপর দু’জন বাইরে হাঁটতে অথবা ঘুরতে বেরুতাম। আর প্রতি উইকএন্ড-এ মুভি দেখা এবং রেস্টেুরেন্টে খেতে যাওয়া কখনোই Miss হতো না।
আজকাল আর এসব কিছু হয় না। কোনো সারপ্রাইজ নেই। নেই কোনো আনন্দ, উল্লাস, উপহার। সম্পর্কটা মনে হয় পানশে হয়ে গেছে। সম্পর্কে আজ এমন কিছু নেই, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা আবার পুরনো দিন ফিরিয়ে আনতে পারি। আমি মাঝে মধ্যেই তার এই বদলে যাওয়া আচরণগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু সে কোনো জবাব দেয় না। কানেই তোলে না। বরং দুর্ব্যবহার করে। কাজের চাপের কথা বলে। অফিসে ব্যস্ততার কথা বলে। আগে তার অফিসিয়াল ট্যুর তেমন ছিল না। এখন প্রায় ঢাকার বাইরে ট্যুরে যাওয়ার কথা বলে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ক’দিন পর ফিরে আসে। বলে চাকরিতে সিনিয়র হয়ে গেছি। তাই এখন যেমন কাজ বেড়েছে, ট্যুরও বেড়েছে।
অনেক দিন ধরেই আমাদের সম্পর্ক একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। এখন সে অফিস থেকে ফিরে কাপড় ছেড়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে, অথবা একা একা টিভি দেখে কিম্বা কম্পিউটার বা ল্যাপটপ নিয়ে বসে, মোবাইল ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলে বা বই পড়ে। আমার খোঁজ-খবর নেয় না। এমন কি, আগে সে ছেলেমেয়ের পড়াশুনার খোঁজ-খবর নিতো, এখন সেটাও না। আগে রাত ১০টায় সবার সঙ্গে খেতে বসতো। এখন সে সবের বালাই নেই।
শুধু তাই নয়, আগে সে মিথ্যা বলতো না। এখন প্রায়ই মিথ্যা বলে। সব সময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। প্রায়ই তার মা, বোন বা অন্যদের সঙ্গে আমার তুলনা করে। অথচ দু’জন দু’জনকে দু’জনের মতো করে মেনে নেবে—এমনটাই দাম্পত্য জীবনের কাম্য। কারণ, পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষ আলাদা। সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেটা মেনে নেওয়ার মতো ‘minimum common sense’ থাকতে হয়।
দু’জনে দু’জনকে সমান গুরুত্ব দেবে, বিশ্বাস করবে। একজন আরেকজনের ভালো-মন্দ দেখাশোনা করবে। পরস্পরের প্রতি মনোযোগ দেবে। পরস্পরকে সুখি রাখার চেষ্টা করবে। দু’জনে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। সবকিছু দু’জন ভাগাভাগি করবে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দু’জন দু’জনকে ভালোবাসবে। একে অপরকে সময় দেবে। তাহলেই না দাম্পত্য সম্পর্ক মধুর ও বন্ধুত্বপূর্ণ হবে।
কিন্তু সম্পর্কের মধ্যে উদাসীনতা, আবেগহীনতা, অসহযোগিতা, যোগাযোগহীনতা, অস্বচ্ছতা থাকা উচিত নয়। কোনো ক্ষোভ, বিরক্তি, তিক্ততা, অকৃতজ্ঞতা, অমিমাংসা, বিচ্ছিন্নতা, অসংযুক্তিতা, যৌন অসন্তুষ্টি বা যৌন অসম্পৃক্ততা অথবা অপূর্ণতা এবং পরস্পরের প্রতি অসম্মান, মনোমালিন্য বা কথা কম বলা এবং নিরাসক্ততা সম্পর্ক নষ্ট করে। আমরা কি এখন সে পথেই এগুচ্ছি?
শ্যামলী নিজেকে প্রশ্ন করেন, তাহলে কী হুমায়ূন আহমেদের কথাই সত্য? তিনি বলেছেন, “ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে বিয়ে না হওয়াটাই ভালো। বিয়ে হলে মানুষটা থাকে, ভালোবাসা থাকেনা। আর যদি বিয়ে না হয়, তাহলে হয়তোবা ভালোবাসাটা থাকে। শুধু মানুষটাই থাকেনা। মানুষ এবং ভালোবাসার মধ্যে ভালোবাসাই হয়তো বেশী প্রিয়।”
তাহলে কী হুমায়ূন আহমেদের এই কথাটাই মানতে হবে যে, “স্বামী – স্ত্রী উভয়েরই পরস্পরের প্রতি এক্সপেকটেশন বা প্রত্যাশা যতো কম রাখা যায়, ততোই মঙ্গল। তাহলেই বিবাহিত জীবন শান্তিময় হয়।”
পরস্পরের চাওয়া-পাওয়া ও ভালো-মন্দ বুঝা, পরস্পরকে ছাড় ও সম্মান দেয়া, পরস্পরের আশা-ভরসা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার মূল্য দেয়া এবং পরস্পরের প্রতি উদারতা ও ইগো পরিত্যাগ করা দাম্পত্য সম্পর্কের চাবিকাঠি।
কারণ, ‘দাম্পত্য’ মানে দু’জনের বিশ্বাস। বিশ্বাস শব্দের আরেক রূপ হলো ভালোবাসা, সততা ও প্রত্যয়। মূলত দু’জনের সততা, ভালোবাসা ও প্রত্যয়ের মিলনই ‘দাম্পত্য’। সংসারে দু’জন দু’জনকে অনেক দাম দিতে হবে। দায়িত্বশীল হতে হবে, সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধন থাকতে হবে, তবেই হবে ‘দাম্পত্য’। সুস্থ, সুন্দর ও আবেদনময় একান্ত সম্পর্ক ছাড়া দাম্পত্য কখনোই সুখের ও প্রেমময় হয় না। (চলবে)