দ্যুতিময় বুলবুল
দশম পর্ব
শ্যামলী ভাবছেন, আমার মনে হচ্ছে-পুরানো প্রেমের নতুন রূপে আবির্ভাবের পর থেকেই সোমেনের আচরণ বদলে যেতে শুরু করে। তবে এখন সে আমার সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক করার চেষ্টা করছে। সব কিছু স্বাভাবিক করতে চাচ্ছে। নানাভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। সময় অসময়ে কথা বলছে। এমনকী, আমার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যানও করছে। আমি তার কর্মকাণ্ডের সবটাই বুঝতে পারছি।
কিন্তু আমার এসব কিছুই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে, সব যেন সোমেন জোর করে মনের বিরুদ্ধে করছে! এখন সে যা কিছু করছে, সবটাই মেকি! আমি কি সবকিছু নিয়ে বেশি ভাবছি? হতে পারে, আমি হয়ত বেশি ভাবছি। সোমেন হয়ত সত্যিই সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা করছে। এ জন্যে যথেষ্ট পরিশ্রম করছে। এফোর্ট দিচ্ছে। সোমেন যদি আমাকে ঠকাতে না চায় এবং সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে, তবে এই কথাও মনে করতে পারি যে, সোমেন হয়ত অপরাধবোধে ভুগছে। তাই আমাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।
তবে সোমেন আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে, নাকি আমাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে- এখনো বুঝতে পারছি না। সত্য়িই কি সোমেন সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে, নাকি উপর উপর সব কিছু স্বাভাবিক দেখানোর ভান করছে? কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে কল্যাণীকে নিয়েই নতুন করে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখছে। আর আমার মতি-গতি পরীক্ষা করছে? তবে সে যে ভীষণ চিন্তিত, সেটা বুঝতে পারি।
যদি ধরেই নেই, সোমেন সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে, তাহলে প্রশ্ন হলো- কীভাবে সে সবকিছু স্বাভাবিক করবে? তাকে তো যে কোনো একজনকে বেছে নিতে হবে। হয় আমাকে, না হয় কল্যাণীকে। সোমেন কি তা করবে? যদি সে তাই করতো, তাহলে তো কল্যাণীকে তার জীবনে ফিরিয়ে আনতো না। বিয়ে করতো না। এই সমস্যাটা নিয়ে আগেই আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতো। বুদ্ধি-পরামর্শ নিতো। সহযোগিতা ও সমাধান চাইতো। কিন্তু তা সে করেনি। কল্যাণীকেও আমার সঙ্গে পরিচয় করে দেয়নি। তাছাড়া, কল্যাণীও কোনো দিন আসেনি আমার সঙ্গে পরিচিত হতে। তাই মনে হচ্ছে, কল্যাণী হয়ত রাজি হবে-যৌথ পরিবারে। কিন্তু আমি কী করবো?
সংসার ছাড়বো, নাকি ছেলেমেয়ের মুখের দিকে চেয়ে সবকিছু মেনে নিয়ে সোমেনের সঙ্গে থেকে যাব? এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি দিশেহারা, ক্লান্ত। কারণ, সংসার জীবনে প্রবেশ করার পর একটি পুরুষ এবং একটি নারী পরস্পরের সঙ্গে শারীরিক, মানসিক ও আত্মীক সম্পর্কে আবদ্ধ হয় । তারা সফলতা-ব্যর্থতা, লাভ-ক্ষতি, ভালো-মন্দ, দুঃখ-কষ্ট, সুখ শান্তি, অর্থ-সম্পদ, সমৃদ্ধি-সম্পত্তি, রোগ-শোক সবকিছুতে পরস্পরের সঙ্গী হয়।
সংসারে একটা সময় সন্তান-সন্ততির জন্ম হয়। গড়ে ওঠে একটি পরিবার। পরিবারের জন্য দু’জনকেই সবরকম দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয় । অর্থ-সম্পদ অর্জন, উপার্জন, জমানো এবং আয়-ব্যয় ও জীবনযাপন তখন পারস্পরিক দায়িত্ব ও যৌথ স্বার্থের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় । পুরুষটি নারীর প্রতি এবং নারীটি পুরুষের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের ফলে তাঁরা সংসারকে টেকসই এবং স্বচ্ছল করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়।
আমরাও পারিবারিক ও সামাজিক নিয়মে তাই করেছি। দীর্ঘদিনের এক বন্ধনে জড়িয়ে গেছি। এই বন্ধন তো ইচ্ছা করলেই অস্বীকার করা যায় না, ছেঁড়াও যায় না। কিন্তু অবিশ্বাসের সম্পর্ক তো টানাও যায় না। বিশ্বাসের ঘরে অবিশ্বাস এবং ভালোবাসার ঘরে ঘৃণা যখন গোপনে সিঁধ কেটে ঢ়ুকে পড়ে, তখন পরিবার তার আপন বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। তখন ভালোবাসার বিপরীতে ঘৃণার এবং বিশ্বাসের বিপরীতে অবিশ্বাসের লড়াই শুরু হয়। সংসারে অশান্তির আগুন জ্বলে।
মানুষ সারা বিশ্বের সঙ্গে লড়াই করে চলতে পারে, কিন্তু পরিবারে স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে লড়াই করে চলতে পারে না। কারণ, একতা হলো একটি সুখী পরিবারের মূল ভিত্তি। ফলে পরিস্থিতি যাই হোক, কেউ কখনো পরস্পরের হাত ছাড়তে চায় না। পরিবার ছাড়া প্রতিটি মানুষ এই পৃথিবীতে একা। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হলো পরিবার। একটি সুখী পরিবারে প্রত্যেক সদস্য পরস্পরের পরিপূরক। তাই ভালোবাসার অপর নাম পরিবারও বটে। যে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঐক্য সংহতি ভালোবাসা এবং বিশ্বাস থাকে, সেই পরিবার সর্বক্ষেত্রে সুখী ও সমৃদ্ধ হয়। তাই বাইরের অবাঞ্ছিত ও অপ্রত্যাশিত প্রভাব ঠেকিয়ে সুখী পরিবার গড়তে হয়।
যদি দুনিয়ার সবাই একদিকে থাকে, আর পরিবার অপরদিকে। মানুষ পরিবারকেই বেছে নেবে। কারণ, পরিবারই সুখে দুঃখে সবচেয়ে বড়ো শক্তি। তাই পরিবারে সর্বদা শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করতে হয় এবং পরিবারের ওপর যাতে কোনো বিপদ না আসে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। যেহেতু যে কোনো ব্যক্তির কাছে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর পরিবার, পারিবারিক জীবন। তার ভিত্তি হলো ভালোবাসা ও বিশ্বাস।
পরিবারে ভালোবাসা ও বিশ্বাসে ভর করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক, মানসিক ও সাংসারিক বন্ধন ও আত্মীক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মনের বন্ধন দৃঢ় হয়। স্বামী স্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে বিবাহ রেজিস্ট্রি হলো একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কারণ, বিবাহ তথা Marriage, matrimony বা wedlock হলো একটি সামাজিক চুক্তি বা সামাজিক বন্ধন-আইনগত বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে দু’জন নারী-পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
কিন্তু দাম্পত্য সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ ভীষণ জরুরি। তা না হলে সেখানে একটা অদৃশ্য দূরত্ব সৃষ্টি হবে, যা পরস্পরের অজান্তে সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তুলবে। দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসার রকমফের হবে নিঃস্বার্থ। যেটাকে বলে প্রতিদানহীন ভালোবাসা। কারণ, বিবাহিত জীবন হচ্ছে, যে কোনো উপহারের চেয়ে উত্তম ও পবিত্রতম সম্পর্ক।
তাই আজীবনের জন্য স্বামী-স্ত্রী হয়ে থাকার জন্য যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটি হলো-বিশ্বাস ও ভালোবাসার বন্ধন। প্রাচীন ভারতের মেকিয়াভেলি খ্যাত অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক এবং অর্থশাস্ত্র রচয়িতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য ও তাঁর পুত্র বিন্দুসারের রাজ-উপদেষ্টা চাণক্য (কৌটিল্য) বলেছেন, পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্মান ও সমর্পণের মন- স্বামী-স্ত্রীর এই তিনটি গুণ হলো সুখী দাম্পত্যের চাবিকাঠি।
কারণ মহা পণ্ডিত চাণক্য মনে করেন, যে কোনো সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় বিশ্বাসের ওপর ভর করে। বিশ্বাস না থাকলে কোনো সম্পর্কই কাঙ্খিত পরিণতিতে পৌঁছতে পারে না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও তেমনি। তাই তাতে যেন চিড় না ধরে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেমন মজবুত, তেমনই স্পর্শকাতরও বটে। পরস্পরের প্রতি সমর্পণ, মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। যাতে দাম্পত্য প্রেমে ঘাটতি না হয়।
চাণক্য মনে করতেন, প্রেমের শক্তি অপার-অপরাজেয়। দাম্পত্য জীবনে যেন প্রেমের ঘাটতি না ঘটে। পরস্পরকে মানিয়ে নেওয়া এবং একে অপরকে বিশ্বাস করার মতো মানসিকতা না থাকলে, প্রেম বেঁচে থাকে না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে প্রেম যতো বেশি থাকবে, সম্পর্ক ততোই মজবুত হবে।
কিন্তু আমার জীবনে বিশ্বাস আর ভালোবাসা, এই দু’টি শব্দের আজ কোনো জায়গা নেই। অথচ ভালোবাসা ও বিশ্বাস পরিবারের ভিত্তি। যে পরিবারে বিশ্বাস ও ভালোবাসা থাকে না; সেই পরিবারে সুখ-শান্তি থাকে না। পরিবারে সুখ-শান্তি বজায় থাকে ভালোবাস, সম্মান, সততা, বিশ্বাস ও যত্নে। মূলত ভালোবাসা ও বিশ্বাস এমন এক বিস্ময়কর অদৃশ্য অনুভূতি, যা মানুষকে কখনো নিয়ে যায় সুখের সর্বোচ্চ শিখরে, আবার কখনো ভাসায় দুঃখের গভীর গহীন সাগরে, দু’ চোখের নোনা জলে। আর এই যত্ন করে কাঁদানোর দায়িত্ব পালন করে সবচে’ কাছের মানুষ! আসলে সমরেশ মজুমদারের কথাই ঠিক, “পৃথিবীর নিয়ম বড় বিচিত্র, যাকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাস, সেই তোমার দুঃখের কারণ হবে।” (চলবে)
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।