একটি ত্রিভুজ প্রেমের দম্পতির জবানবন্দী

Spread the love

দ্যুতিময় বুলবুল
৬ষ্ঠ পর্ব

সোমেন কল্যাণীর সঙ্গে তার প্রেম ও বিয়ের কাহিনি যখন বলছিল, তখন আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু বন্যা বইছে। মনে পড়ছে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা, “যাহাকে ভালোবাসি সে যদি ভালো না বাসে, এমনকি ঘৃণাও করে, তাও বোধ করি সহ্য হয়! কিন্তু যাহার ভালবাসা পাইয়াছি বলিয়া বিশ্বাস করেছি, সেইখানে ভুল ভাঙ্গিয়া যাওয়াটাই সবচেয়ে নিদারুণ। পূর্বেরটা ব্যথা দেয়। কিন্তু শেয়ারটা ব্যথাও দেয়, অপমানও করে।”

সোমেনের কথা শুনতে শুনতে আমি ভাবলাম, সোমেন কল্যাণীকে যতটা ভালোবেসেছে, আমাকে হয়ত কখনোই ততটা ভালোবাসেনি। তাহলে কেন সে আমাকে তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো। আর যদি জড়ালোই, তবে ২১ বছর পর কেন সে জীবনে কালবৈশাখী ঝড়ের চরম বিপর্যয় ডেকে আনলো। সোমেনের জন্য কী করিনি আমি? ২১ বছরের সম্পর্কের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম- ভালোবাসা, ত্যাগ-তিতিক্ষা- সব কিছু কীভাবে সে বেমালুম ভুলে গেল!

ছেলে মেয়ের কথাও সোমেন ভাবলো না! ছেলে শুভ্র দশম শ্রেণীতে এবং মেয়ে কান্তা অস্টম শ্রেণীতে পড়ছে। তাদের কাছেই সে মুখ দেখাবে কীভাবে! আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সমাজের কাছে সে কী জবাব দেবে? জীবন তো আমাদের ভালোই কাটছিল। আমি তো তাকে সত্যিই মনেপ্রাণে ভালোবেসেছিলাম।

যাকে বলে, True & Profound Love. যেখানে শুধু সত্যিকারের ভালোবাসাই ছিল না, ছিল সততা, প্রতিশ্রুতি ও অটল আনুগত্য। যে প্রেম ছিল নিঃশর্ত ও সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং চ্যালেঞ্জের মুখেও অবিচল। অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ভক্তি ও পারস্পরিক সমর্থনের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল সেই ভালোবাসা। শক্তিশালী এবং নিরঙ্কুশ প্রেমের পাশাপাশি ছিল একটি আবেগময় জীবনের প্রতিজ্ঞা এবং স্বপ্নময় জীবনের প্রত্যাশা।

সোমেনের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া কল্যাণী হঠাৎ করে কেন আবার তার জীবনে ফিরলো? তারও কী ভাবা উচিত ছিল না, তাদের প্রেম এখন অতীত। তাদের বিনে সুতার মালা ছিঁড়ে গেছে অনেক আগেই। সোমেনের স্ত্রী-সন্তান আছে। তাদের জীবন ও স্বপ্ন এখন একই সুতায় গাঁথা।

সোমেনের দাবি, কল্যাণী যে আকর্ষিকভাবে হঠাৎ করে তার জীবনে ফিরে আসবে তা সে জানতো না। সোমেন আরো বলছে, জীবনে ফের কল্যাণীকে গ্রহণ করতে হবে, এ জন্যও সে প্রস্তুত ছিল না। তাহলে কল্যাণী কি সোমেনকে বাধ্য করেছে? নাকি সোমেনের পুরানো প্রেম আবার নতুন করে পাখা মেলেছে? কেন সোমেন স্ত্রী-সন্তান থাকা সত্ত্বেও অর্বাচীনের মতো এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলো?

সোমেন জানায়, কল্যাণী একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে তার সংক্ষিপ্ত সংসার জীবনের অশান্তি ও বিচ্ছেদের কাহিনি তুলে ধরে। আমি পীড়াপীড়ি করার কারণেই কল্যাণী তার সংক্ষিপ্ত বৈবাহিক জীবনের না বলা কথা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। কল্যাণীর সেই বৈবাহিক জীবনের গল্প শুনে আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, স্বামীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদের কারণ আসলে আমি নিজেই। আমার প্রতি অধিক ভালোবাসার জন্যই কল্যাণী তার জীবনে অন্য পুরুষকে গ্রহণ করতে পারেনি। আমাকে সে কোনো দিন ভুলতে পারেনি। আমার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতেও চায়নি কল্যাণী। স্বামীর সঙ্গে যতদিন সে বসবাস করেছে, একদিনও তাদের সহবাস হয়নি। সন্তান ধারণ তো দূরের কথা!

সোমেন আমাকে বলতে থাকে, শ্যামলী- তোমাকে আর একটা কথা জানাই। আমি ও কল্যাণী যখন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়তাম, তখন দোল উৎসবে যোগ দিয়ে সবার সঙ্গে জগন্নাথের মন্দিরে প্রচুর রঙ খেলেছিলাম। ওইদিন আনন্দের আতিশয্যে আমরা এতোটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম যে, মন্দিরে দেবতাকে স্বাক্ষী রেখে পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার শপথ নিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, আবেগপ্রবণ হয়ে কল্যাণীর সম্মতিতে তার সিঁথিতে আমি গোপনে সিঁদুরও পরিয়েছিলাম। সেই থেকে সে আমার কল্যাণে আজও সিঁদুর পরে চুল দিয়ে ঢেকে রাখে।

সেই শপথ অনুযায়ী আমরা পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই মানতাম, যদিও সেটা কেউ জানতেন না। পরবর্তীতে কল্যাণীর পরিবার জোর করে তাকে বিয়ে দিলেও, কল্যাণী তার শপথ থেকে এক চুলও নড়েনি। বিয়ের পর সে তার স্বামীকেও সে কথা জানিয়েছিল। কিন্তু তার স্বামী এটাকে ছেলেমানুষী বলে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন, ওই শপথের কোনো আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক ভিত্তি নেই।

কল্যাণী তার স্বামীকে জবাব দিয়েছে, সমাজ, প্রতিষ্ঠান কিংবা আইন মানুষের মনের উর্ধ্বে নয়। মন হলো সবচাইতে বড় যুক্তি শাস্ত্রবিদ। তাই মনের কথাই আসল কথা। মনের কাছে যুক্তি-তর্ক, আইন- কানুন, শাস্ত্র-মন্ত্রের কোনো মূল্য নেই। মনের উপর কারও হাত নেই। তাই কারো মনের উপর জোর খাটানোর চেষ্টা করা বৃথা।

সাবেক ফরাসি সম্রাট ও সামরিক অধিনায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, বিশ্বে দু’টি শক্তি রয়েছে–এগুলো হচ্ছে অসি ও মন। কিন্তু এ দুয়ের দ্বন্দ্বে মনের কাছে অসি শেষ পর্যন্ত পর্যদুস্ত হয়। পৃথিবীতে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিন্তু মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আর মনকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যেত, তাহলে দুঃখ কী জিনিস তা মানুষ কখনোই বুঝত না।

দুনিয়াতে মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই। আবার মানুষের মাঝে মনের চেয়ে বড় কিছু নেই। মনের মতো মানুষ ছাড়া সংসার করা, আর ডাস্টবিনের পাশে বসে থাকা একই কথা। তাই জনপ্রিয় বাঙালি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, যাকে তাকে গছিয়ে দেওয়ার নামই বিবাহ নয়! মনের মিল না হলে বিবাহ করাই ভুল। কল্যাণীর স্বামী বহু চেষ্টা করেও তাকে জীবনসঙ্গী করতে পারেন নি। ফলে শেষ পর্যন্ত তারা মিউচুয়াল কনসেন্ট (Mutual Consent) এ তাদের ডিভোর্স ( Divorce) সম্পন্ন করে।

দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।