দ্যুতিময় বুলবুল
চতুর্থ পর্ব
এরপর থেকে আমি সোমেনকে নজরে রাখি। ভাবতে থাকি, তার কলিগের কাছ থেকে যে পরকীয়ার খবর পেয়েছি, সেটা হয়তো সত্য! যদিও সোমেন ওই মহিলার কাছে মোবাইল ফোনে প্রেমের বার্তা পাঠায় না, হয়তো ধরা পড়ার ভয়ে। কিন্তু সারাদিন সে ওই মহিলার সঙ্গে মোবাইল ফোনে অফিসের মধ্যে, বাড়ি থেকে কিংবা বাইরে থেকে নানা আলোচনা করে।
কিন্তু সে আমার সঙ্গে এখন মেপে কথা বলে। চোখের সামনেই যেন সে পড়তে চায় না। আমার তো এসব মোটেই ভালো লাগে না। দিনে দিনে মনটা বিষিয়ে উঠেছে।
অথচ এখনো সোমেন অফিস থেকে বাড়ি ফিরার আগেই প্রতিদিন তার জন্যে রান্না করে খাবার নিয়ে বসে থাকি আমি, আগের মতোই। ওর পছন্দের পদ বানানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সে বাড়ি ফিরে কোনো দিন খায়, আবার কোনো দিন না খেয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে বসে পড়ে। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। তাই আজকাল আমার খুব একা লাগে। আমি ছেলে মেয়েকেও কষ্টের কথা কিছুই বলতে পারি না।
এখন এমন অবস্থা যে, আমি মাঝে মধ্যে সোমেনের কাছে সময় চাই। বেড়াতে যেতে চাই। কিন্তু সে আমার ডাকে সাড়া দেয় না। এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। কাজের অছিলা দিয়ে কেটে পড়ে। নানা ধরনের ব্যস্ততা দেখায়। আমার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সুযোগ পেলে খোটা দেয়! সোমেনের এসব আচরণে আমার মন ভেঙে যায়।
অথচ আত্মীয়-স্বজনরা সবাই আমার কাজের প্রশংসা করে। বাড়িতে শুধু স্বামীর কাছে আজকাল কোনো সম্মান পাই না। এতো আত্মত্যাগ করেও এখন আমি স্বামীর মন পাই না! সোমেন কী তাহলে সব সময় আমাকে এভাবে Avoid করে অন্য মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাবে? জানি না আর কী করলে ওকে কাছে পাব। হতাশায় ডুবে যাওয়া ছাড়া আমার সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।
একদিন হঠাৎ কী মনে করে সোমেনের অফিসে গেলাম। তারপর জানলাম, সেখানে এক নারী সহকর্মীর সঙ্গে তার পরকীয়া সম্পর্ক ‘ওপেন সিক্রেট’ (Open Secret)। সেই নারীকেও দেখলাম। এ সবকিছু জেনেশুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। তাহলে কী সোমেনের সম্পর্কে পরকীয়ার অভিযোগ সত্য! সত্য আমার সন্দেহটাও!!
তবে সোমেনকে ওর অফিসে কিছু বললাম না। বাসায় ফেরার পর, শোয়ার আগে তাকে অফিসের ওই নারীর সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি জিজ্ঞেস করলাম। প্রথমে সোমেন সব কিছু অস্বীকার করলো। পরে তার কাছে নানা ঘটনার বিবরণ ও তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরলাম। তার বদলে যাওয়ার লক্ষণ ও আচরণগুলো জানালাম। ফলে শেষ পর্যন্ত সোমেন সত্যটা স্বীকার করতে বাধ্য হলো। শুধু তাই নয়, ওই মহিলাকে সে যে গোপনে বিয়ে করেছে, সেই কথাও জানালো।
সোমেন আমাকে বললো, কল্যাণী আমার ছোটবেলার ভালোবাসা। একইসঙ্গে বড় হয়েছি আমরা। সে ছোটবেলায় গার্লস স্কুলে পড়লেও, কলেজ জীবনে আমরা একইসঙ্গে পড়াশুনা করেছি। আমরা পরস্পরের বাড়িতে আসা যাওয়া করতাম। কারণ, সে আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। পড়ালেখার ছলে আমরা দিনের বিরাট একটা সময় একসঙ্গে কাটাতাম। কিন্তু আমাদের উভয় পরিবার এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায়, এক সময় আমাদের প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেল। শুধু দুই পরিবার নয়, আমাদের কলেজ সহ পুরো মফস্বল শহরেই এ নিয়ে নানা গুঞ্জণ ও গুজব ছড়িয়ে পড়লো। ফলে আমাদের পরস্পরের বাড়িতে আসা যাওয়া বন্ধ হলো।
কল্যাণীর ওপর পারিবারিক কড়াকড়ি ক্রমেই বাড়তে লাগলো। কিন্তু আমাদেরকে তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেন না। প্রতিদিন আমরা কলেজে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গোপনে দেখা করতাম। কোনো বন্ধুর বাসায়, কলেজ হোস্টেলে কিংবা ঘনিষ্ট বন্ধুদের ম্যাচে অথবা দূরে কোথাও, দূরে দূরে, বহু দূরে। অন্য কোথাও, অন্য কোনো খানে।
কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার পর আর সেই সুযোগ থাকলো না। কল্যাণীকে পুরোপুরি বাড়িতে আটকে ফেললো তার পরিবার। পরীক্ষায় আমরা দু’জনেই প্রথম শ্রেণীতে পাশ করলাম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। কিন্তু কল্যাণীর বাবা মা তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে দিলেন না, আমার কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি হতে বাধ্য করা হলো।
তবুও আমাদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হলো। আমি মাঝে মধ্যেই ঢাকা থেকে রাজশাহী গিয়ে কল্যাণীর সঙ্গে দেখা করতাম। কয়েক দিন সেখানে বিভিন্ন হলে বন্ধুদের সঙ্গে থাকতাম। সেও একাধিকবার ঢাকায় এসে বান্ধবীর সঙ্গে রোকেয়া হলে থেকে আমার সঙ্গে দেখা করেছে। একসঙ্গে ঘুরেছি।
কিন্ত এই যোগাযোগ বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এলাকার ছেলে মেয়েদের মাধ্যমে কল্যাণীর পরিবারে খবর পৌঁছে গেল। ফলে অর্থনীতি প্রথম বর্ষে থাকতেই জোর করে কল্যাণীর বাবা-মা তাকে রাজশাহীতেই এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। কিন্তু সংসার জীবন তাদের সুখের হলো না।
শুরুতেই তাদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব ও অশান্তি তৈরি হলো। অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর, এক পর্যায়ে কল্যাণী স্বামীর সংসার ত্যাগ করে ঢাকায় এসে নীলক্ষেত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে ওঠে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একের পর এক চাকরির পরীক্ষা দিয়ে, শেষ পর্যন্ত আমাদের ব্যাংকেই সে চাকরি পেলো।
ব্যাংকে প্রথম যেদিন কল্যাণীকে দেখলাম, আমি কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এটা সত্যি কোনো ঘটনা। ব্যাপারটা পুরোটাই আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হলো। যদিও সে আগে থেকেই জানতো আমি এই ব্যাংকে চাকরি করি, কিন্তু তারপরও কোনো দিন সে আমার সঙ্গে দেখা করেনি।
কিন্তু চাকুরি যে তার আমারই ব্যাংকে এবং আমারই শাখায় হবে, সেটা সে কখনো ভাবতে পারেনি। তাই ক’বছর পর প্রথম দেখাতেই আমরা উভয়েই বিস্মিত হয়ে পড়েছিলাম। কল্যাণী তো একেবারে কেঁদেই ফেলেছিল। আমিও নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে কল্যাণী সেদিন আমার উদ্দেশে আবৃত্তি করেছিল, “আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু–একই আলো পৃথিবীর পারে আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়, প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়… ” । (চলবে)
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।