দ্যুতিময় বুলবুল
পঞ্চম পর্ব
কল্যাণীকে জীবনানন্দ থেকেই জবাব দিলাম আমি,“ — অতিদূর সমুদ্রের ’পর/হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা/ সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,/ তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?”
সোমেন জানায়, তারপর থেকেই কল্যাণীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অবচেতন মনেই আগের মতো আমরা কাছে আসি। কল্যাণী নীলক্ষেত কাটাবনে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল ছেড়ে ধানমণ্ডিতেই আমাদের এইচএসবিসি (HSBC) ব্যাংকের কাছাকাছি বাসা ভাড়া নেয়। তারপর আমাদের যোগাযোগ ক্রমশ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে গত বছর আমরা বিয়ে করি।
সোমেন বলতে থাকে, এসব কথা তোমাকে বলা হয়নি। আসলে আমি কখনো তোমাকে বলতে সাহস পাইনি। তোমার প্রতি আমি যে অন্যায় ও অবিচার করেছি, সেটা আমি খুব ভালোভাবেই বুঝি। এই অপরাধবোধের কারণে তোমার সঙ্গে আমার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। বিবেকের দংশনে আমি তোমার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারতাম না। তাই তোমাকে আমি এতদিন অনেকটা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। মনের বিরুদ্ধে জোর করে তোমাকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছি। আমার ধারণা, আমাদের মধ্যে যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তা তুমি বুঝতে পারো।
সোমেন বলে, তবে একথা সত্য যে-কল্যাণীকে হারিয়ে একটা বছর কী যে হাহাকার ছিল আমার মনে, তা আমি কাউকে বুঝাতে পারব না! তারপর অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে তুমি যখন আমার জীবনে এলে, তখন আমি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। হতাশা থেকে বেরিয়ে এলাম। এ যেন অসাড় দেহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা। সত্যিই তোমাকে আমি মনেপ্রাণে ভালোবাসলাম। তোমাকে পেয়ে আমার জীবনের নতুন স্বপ্নযাত্রা শুরু হলো। রবীন্দ্রনাথের অপুর মতো “আমার মন বারবার করিয়া বলিতে লাগিল, ‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।”
একটানা সোমেন তার কথাগুলো বলে গেল। আমি কিছু বললাম না। সোমেনের মুখের দিকে নীরবে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলাম। আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম। সোমেন এখন যেন পুরোপুরি একজন অজানা-অচেনা মানুষ। অনেক দূরের কেউ। তার চলন-বলন, সব বদলে গেছে। মনে হচ্ছে- এই সোমেনকে আমি চিনি না, কোনো দিন কখনো দেখেনি তারে! সে এখন একজন অন্য মানুষ, নতুন মানুষ!
আমার জীবনটা এতদিন কানায় কানায় ভরা ছিল। আমি কোথাও কোনো শূন্যতা দেখিনি। আজ হঠাৎ বুকের ভেতর একটা বিরাট নৈরাশ্যের ‘ব্ল্যাক হোল’ বা ‘কৃষ্ণগহ্বর’ সৃষ্টি হলো ৷ কেমন করে, কী দিয়ে, আমি সেই ‘কৃষ্ণগহ্বর’ থেকে বেরিয়ে আসবো?
সোমেন আমাকে তার বুকে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠোটে চুমু দিয়ে বলল, “শ্যামলী, আমি জানি তুমি খুব দুঃখ পেয়েছ, কষ্টে তোমার বুক ফেটে যাচ্ছে। তাই আমার ওপর তোমার ভীষণ রাগ ও অভিমান হয়েছে ৷ এটাই স্বাভাবিক। তবে আমি তোমার প্রেম ও সত্যে কখনো আঘাত করর না, আমি যে তোমার অনন্ত প্রেম ও সত্যের বাঁধনে বাঁধা৷” রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও প্রকৃতি থেকে সোমেন আবেগঘণ কণ্ঠে অস্ফূট স্বরে আবৃত্তি করলো,“ — একবার বলো, সখী, ভালোবাস মোরে—/রেখো না ফেলিয়া আর সন্দেহের ঘোরে।”
আমি কিছু না বলে একটু হাসলাম৷ সে হাসির ভাষা শুধু আমিই জানি। এই ভাষা অন্য কারো বোঝার শক্তি নেই। বোঝানোরও দরকার নেই ৷ বাঙালির সুখ-দুঃখের আশ্রয়, রবীন্দ্রনাথ থেকে মনে মনে উচ্চারণ করলাম, “সখা হে, কী দিয়ে আমি তুষিব তোমায়।/জরজর হৃদয় আমার মর্মবেদনায়,/দিবানিশি অশ্রু ঝরিছে সেথায়॥”
আমি স্পষ্ট উপলব্ধি করছি, আমার বুকের গহীন গভীরে কে যেন ধক ধক করে ধাক্কা দিচ্ছে, স্বামীর প্রতি মনের মধ্যে একটা নিরঙ্কুশ বিশ্বাসের যে অসাবধান স্বচ্ছ আবরণ ছিল, তা মুহূর্তের মধ্যে ছিঁড়ে গেল ৷ এমন নিঃশব্দ গভীর বেদনার ভয়ঙ্কর রূপ আমি এতদিন এভাবে কখনো স্পষ্ট করে দেখিনি! কোনো দিন ভাবিও নি। তাই আমার বুকের ভিতরে তীব্র হাহাকার চলছে। আর হুহু করে বাড়ছে কষ্টের পারদ ৷
অথচ একটা সময় ছিল, যখন সোমেনের চোখের দিকে তাকালে আমি তার মনের কথা বুঝতে পারতাম। এখন তার অন্তর-বাহির ভিন্ন। ব্যবধান বিশাল। মুখোশের আড়ালে মুখ। বদলে গেছে চোখের ভাষা। হয়ত বর্তমান ভুলে ভবিষ্যত জীবনের স্বপ্ন বুনছে সে!
তাহলে আমাদের ২১ বছরের প্রেম ও দাম্পত্য সম্পর্ক কী পুরোটাই মিথ্যা হয়ে গেল? নাকি সোমেন রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি উপন্যাসের মহেন্দ্রের মতো আশা ও বিনোদিনী দু’জনকেই চায়? রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আশা ও বিনোদিনী উভয়কে স্থান দিবার মতো প্রশস্ত হৃদয় মহেন্দ্রের আছে।’ যেমন নৌকাডুবি উপন্যাসের নায়ক রমেশ হেমনলিনীর সঙ্গে চিরসখীরূপে কমলাকেও পেতে চায়। বাগানের মালী যেমন গোলাপের সঙ্গে রজনীগন্ধাও ফুটাতে চায়। সোমেনের ভাবনাও কি তাই?
আমি হলফ করে বলতে পারি, আজকাল-এই অত্যাধুনিক যুগে আমার মতো Obedient, Honest ও Devoted স্ত্রী সবার কপালে জোটে না। সোমেন ভাগ্যবান! সে আমাকে পেয়েছিল! সংসার জীবনে সমস্ত কাজের ভার আমি এককভাবে নিজের কাঁধে নিয়েছিলাম। একদিনের জন্যও সোমেন আমার কাছে শোনেনি সংসারটা আমি সামলাচ্ছি কিভাবে। আজ তার এই প্রতিদান?
শ্যামলী যে অন্তরের ভেতরে বাইরে প্রতিটা মুহূর্ত অসহ্য যন্ত্রণায় ছটপট করছে, তা সোমেন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন ৷ সোমেন ভাবছেন, আমি শ্যামলীকে যত কষ্টই দেই না কেন, তাকে ত্যাগ করতে পারব না। বিছানায় শুয়ে হাতের উপর মাথা রেখে জোসনাস্নাত মধ্যরাতে আকাশ-ভরা তারার দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে থাকেন সোমেন। শ্যামলীর বুক ফেটে যাচ্ছে ৷ তার কয়েক ফোটা চোখের জল টপটপ করে সোমেনের গালে পড়লো ৷ এ অবস্থায় সোমেন শ্যামলীকে আর একটি কথাও বলতে পারলেন না, কোনো জিজ্ঞাসাও করলেন না। নির্বাক, নিস্তব্ধ ও কিংকর্তব্যবিমূড় সোমেন।
শ্যামলী ভাবেন, সোমেনকে যে ভালোবাসা দিয়েছি, তা উজাড় করেই দিয়েছি। এখন মুখ ফিরিয়ে নিতে গেলে কেবল দুঃখই পেতে হবে। ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে নিতে যাওয়ার মতো এমন বিড়ম্বনা আর হয় না। কিন্তু বিশ্বাস ও আনুগত্যকে যেকোনো ভালোবাসার সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বাসকে বলা হয় কাঁচের মতো। কাঁচ একবার ভেঙে গেলেও জোড়া লাগানোর পর যেমন তাতে দাগ থাকে, তেমনি বিশ্বাসে একবার আঁচড় লাগলে তা শত চেষ্টায়ও মেশানো যায় না, চিহ্ন থাকে। আগের অবস্থায় আর ফেরানো যায় না।
শ্যামলী নিজেকে প্রশ্ন করেন, আজকের এই পরিণতির জন্য আমার কী দোষ? মূলত আমার দোষ হচ্ছে যে, আমি সোমেনকে অনেক বেশি ভালোবেসেছি। যে ভালোবাসা আমার সমস্ত দেহ-মন ও অন্তর-আত্মার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অক্সিজেন ছড়িয়ে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। সেই ভালোবাসার মধ্যে কোনো খাদ ছিল না। বরং এমন একটি সঞ্জীবনী শক্তি ছিল যে, সংকীর্ণ আসক্তির মধ্যে সে মনকে জড়িয়ে রাখত না, সেই ভালোবাসা চারিদিকে একটি আনন্দময় স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। আজ সেই সুখের স্বর্গে অশনি সংকেত, সর্বনাশা রাহুর ছায়া! (চলবে)
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।