দ্যুতিময় বুলবুল
আজ ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ শুক্রবার, কলম্বিয়ান গায়িকা-গীতিকার, প্রযোজক ও অভিনেত্রী শাকিরার ৪৭তম জন্মদিন। বিশ্বখ্যাত সংগীত তারকা শাকিরার সুরেলা কণ্ঠস্বর ও মোহনীয় নাচ তাঁকে জনপ্রিয় পপ তারকার খ্যাতি এনে দিয়েছে। ‘হিপস ডোন্ট লাই’ খ্যাত কলম্বিয়ার এই তারকা ১৯৭৭ সালের ০২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন কলম্বিয়ার বার্রাংকিলা শহরে। সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা।
গ্র্যামিজয়ী পপ তারকা শাকিরার সম্প্রতি ব্রোঞ্জের একটি বিশাল ভাস্কর্য উন্মোচন করা হয়েছে তাঁর নিজ শহরে। ভাস্কর্যটিতে শাকিরার আকর্ষণীয় নাচের ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আবক্ষ ঝাঁকড়া চুল আর গগনমুখী দু-হাত, সেইসঙ্গে খালি পায়ে স্কার্ট আর বক্ষবন্ধনী পরে ‘বেলি ডান্সের’ ভঙ্গিতে জনপ্রিয় পপতারকা শাকিরার এ রূপ ভক্তদের খুবই চেনা। ১৯ বছর আগের ‘হিপস ডোন্ট লাই’ গানে যে রূপে ধরা দিয়েছিলেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জয়ী এই তারকা; তাঁর সম্মানে সেই অবয়বেই কলাম্বিয়ায় তাঁর শৈশবের শহর বার্রাংকিলায় তৈরি করা হয়েছে এই ভাস্কর্য। ম্যাগডালেনা নদীর তীরে ব্রোঞ্জের তৈরি সাড়ে ৬ মিটার (২১ ফুট) উচ্চতার এই ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।
এই ভাস্কর্য তাঁকে সম্মানিত করেছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন শাকিরা। কলাম্বিয়ায় এটাই শাকিরার প্রথম ভাস্কর্য নয়। এর আগে ২০০৬ সালেও তাঁর একটি ভাস্কর্য উন্মোচন করা হয়েছিল। সেখানে ফুটিয়ে তোলা হয় তাঁর শৈশবের দিনগুলো।
গায়িকা-গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত প্রযোজক, নৃত্যশিল্পী ও জনহিতৈষী শাকিরা ইসাবেল মেবারাক রিপোই বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পীদের অন্যতম। তবে সারা বিশ্বে তাঁকে শুধু শাকিরা নামে ডাকা হয়।
কলম্বিয়ান এই শিল্পী স্কুল জীবনে সরাসরি উপস্থাপনার মাধ্যমে তাঁর প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে শুরু করেন। সেখানে তাঁর নিজস্ব বেলি ড্যান্সিং-এর সঙ্গে তিনি কণ্ঠে স্বার্থকভাবে রক অ্যান্ড রোল, ল্যাটিন, পূর্ব মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গীত ফুটিয়ে তুলতেন। শাকিরার মাতৃভাষা স্প্যানিশ হলেও, তিনি অনর্গল ইংরেজি, পর্তুগিজ এবং ইতালীয় ভাষায় কথা বলতে পারেন।
শাকিরা ছিলেন তাঁর মা নিদাইয়া দেল কারমেন রিপোল তোর্রাদো এবং লেবানিজ বংশোদ্ভূত বাবা উইলিয়াম মেবারাক শাদিদের একমাত্র সন্তান। তাঁর দাদা-দাদি লেবানন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে চলে গিয়েছিলেন। নিউ ইয়র্কে শাকিরার বাবার জন্ম হয়। এরপর ৫ বছর বয়সে শাকিরার বাবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কলম্বিয়ায় চলে যান।
শাকিরা যৌবনকালের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন উত্তর কলম্বিয়ার শহর বার্রানকিলায়। ভালো বুদ্ধিমত্তা ও আইকিউ পরীক্ষায় ভালো স্কোর করার জন্যও শাকিরা বিশেষভাবে পরিচিত। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। সাত বছর বয়স থেকে তিনি বাবার উপহার দেওয়া টাইপরাইটারে নিয়মিত কবিতা লেখা শুরু করেন। তাঁর কবিতাগুলো ক্রমেই গানে রূপ নেয়। শাকিরা আট বছর বয়সে তাঁর প্রথম গান “তুস গ্রাফাস ওসকুরাস” (Tus Gafas Oscuras) লিখেন। যার অর্থ “তোমার কালো চশমা”।
শাকিরা ১৯৯৫ সালে নিজস্ব প্রযোজনায় অ্যালবাম পিয়েস দেসকালসোস (Pies Descalzos) প্রকাশ করেন। এই অ্যালবাম তাঁকে লাতিন আমেরিকা ও স্পেনে খ্যাতি এনে দেয়। এই অ্যালবাম প্রকাশের পর তাঁকে একজন সম্ভাবনাময়ী সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে অভিহিত করা হয়। শাকিরা ১৯৯৫ সালে কলম্বীয় টেলিনোভেলা এল ওয়াসিস-এ লুইসা মারিয়া চরিত্রে অভিনয় করেন।
এরপর ১৯৯৮ সালে দোন্দে এস্তান লোস লাদ্রোনেস (¿Dónde Están Los Ladrones?) অ্যালবামটি প্রকাশ হলে তাঁর জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়। এই অ্যালবাম সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তাঁর গুরুত্ব বাড়াতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে। এই অ্যালবামটির জন্য তিনি রোলিং স্টোন, অল মিউজিক গাইড এবং বিলবোর্ড ম্যাগাজিনের সঙ্গীত সমালোচকদের কাছ থেকে বিপুল উৎসাহ পান।
শাকিরা দুইবার গ্র্যামি পুরস্কার এবং সাতবার ল্যাটিন গ্র্যামি পুরস্কার পেয়েছেন। গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। বিএমআই-এর তথ্যানুসারে, শাকিরা কলম্বিয়ার সর্বকালের সবচেয়ে বেশি অ্যালবাম বিক্রিত শিল্পী। শুধু তাই নয়, তিনি ব্যবসায়িকভাবে সফল দ্বিতীয় ল্যাটিন অ্যামেরিকান নারী শিল্পী, যাঁর অ্যালবাম বিশ্বব্যাপী পাঁচ কোটি কপি বিক্রিত হয়েছে। শাকিরা দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র শিল্পী, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিলবোর্ড হট ১০০, কানাডিয়ান বিলবোর্ড হট ১০০, অস্ট্রেলিয়ান এআরআইএ চার্ট এবং ইউকে সিঙ্গেলস চার্ট-এ প্রথম স্থান অর্জনের গৌরব অর্জন করেছেন।
স্প্যানিশ এবং ইংরেজিতে গান এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের উপর শাকিরার দক্ষতা রয়েছে। একাধিক হিট গানের জন্য বিশ্বব্যাপী ভক্তদের মন জয় করেছেন শাকিরা।
শাকিরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন। তিনি ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি, যিনি ফেসবুকে ১০০ মিলিয়ন লাইক পেয়েছেন। তিনি ম্যারাকানা স্টেডিয়ামে দাঁড়ানো আছেন এমন একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার একটু আগের মুহূর্ত ছিল সেটা। ছবিটি চারদিনে ৩.৫ মিলিয়ন লাইক পেয়েছিল, সে সময় এটাই ছিল শাকিরার সবচেয়ে বেশি লাইক পাওয়া ছবি।
শাকিরা জীবনে একাধিকবার প্রেম এসেছে। তাঁর প্রথম প্রেমিক অ্যান্টোনিও। অ্যান্টোনিও আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্নান্দো ডে লা রুয়ার ছেলে। শাকিরা ও অ্যান্টোনিও দীর্ঘ ১১ বছর একসঙ্গে বাস করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের প্রেম টেকেনি। বিচ্ছেদের পরই শাকিরার বিরুদ্ধে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের মামলা করেছিলেন অ্যান্টোনিও। আদালতে দাখিল করা কাগজপত্রে অ্যান্টোনিও উল্লেখ করেছিলেন, শাকিরা নামটি একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। এর পুরো কৃতিত্ব নিজের বলেই তিনি মনে করেন। এছাড়া শাকিরার তুমুল জনপ্রিয় ‘হিপস ডোন্ট লাই’ ও ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গান দুটি তৈরির ভাবনাও প্রথম তাঁর মাথায় এসেছিল। এসব কারণেই তিনি মনে করেন, শাকিরার আয়ের একটি অংশ তাঁর প্রাপ্য। কিন্তু মামলাটি ধোপে টেকেনি। এরপর আরও তিনটি মামলা করেন অ্যান্টোনিও। কোনো মামলায়ই তিনি সুবিধা করতে পারেননি। সব মামলার রায় শাকিরার পক্ষে যায়।
অ্যান্টোনিওর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর, স্প্যানিশ ফুটবল তারকা জেরার্ড পিকের সঙ্গে শাকিরার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জেরার্ড পিকের সঙ্গে শাকিরার পরিচয় গান ও ফুটবলের মাধ্যমেই। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আগে স্পেনের হয়ে অনুশীলনে শাকিরার সঙ্গে পিকের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। পিকে ছিলেন দলীয় অনুশীলনে আর শাকিরা গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের অফিসিয়াল সঙ্গীত ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গানের রেকর্ডিংয়ে। তখন থেকেই তাঁদের মন দেয়া-নেয়া শুরু।
এক বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেমের ঘোষণা দেন শাকিরা এবং পিকে। জেরার্ড পিকে শাকিরার চেয়ে ১০ বছরের ছোট। তারপরও তাঁদের ভালোবাসায় কোনো সমস্যা হয়নি। তাই বিয়ে করে এই দম্পতি বার্সেলোনায় থাকতেন। শাকিরা ও পিকের মিলান এবং সাশা নামে দুই ছেলে রয়েছে। ২০২২ সালে তাঁদের ১১ বছরের সম্পর্ক শেষ হয়।
বিচ্ছেদের ঘোষণার সময় শাকিরা গোপনীয়তার বজায় রেখেছিলেন। বিচ্ছেদের বিবৃতিতে শাকিরা বলেছিলেন, “দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমরা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের সন্তানেরাই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ভালোর জন্যই আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে সম্মান দেখানোর আহ্বান জানাই। বিষয়টি বুঝতে পারার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।”
বিচ্ছেদের পর শাকিরা মিয়ামিতে বসবাস করছেন।
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।