দ্যুতিময় বুলবুল
কবি কামিনী রায় লিখেছেন, “জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,/ “মা, তোমারে কত ভালোবাসি!”/ “কত ভালোবাস ধন?” জননী শুধায়।/ “এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়।/ “তুমি মা আমারে ভালোবাস কতখানি?”/ মা বলেন “মাপ তার আমি নাহি জানি।“ / “তবু কতখানি, বল।/ “যতখানি ধরে/ তোমার মায়ের বুকে” / “নহে তার পরে?”/ “তার বাড়া ভালোবাসা পারি না বাসিতে।“ /“আমি পারি।” বলে শিশু হাসিতে হাসিতে”।
কবি কামিনী রায়ের এই কবিতার মধ্যেই মা ও সন্তানের সম্পর্ক এবং ভালোবাসার অপূর্ব সুন্দর চিত্র খুব সুন্দভাবে ফুটে উঠেছে। “মা” ছোট্ট একটি শব্দ। এই শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সব মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা। সন্তানের সকল শক্তি ও প্রেরণার উৎস মা।
‘মা’ শব্দটির মতো মিষ্টি, মধুর, কোমল, পবিত্র ও বিশুদ্ধতম শব্দ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে আপন ও সর্বাধিক প্রিয়, সবচেয়ে নিরাপদ ও সর্বাধিক নির্ভার শব্দ মা। শুধু তাই নয়, জগতের সবচেয়ে নিরাপদ, সুখময় ও শান্তিপূর্ণ আবাসস্থল এবং সবচেয়ে দৃঢ়, বিশ্বস্ত ও প্রেমময় ঠিকানা মা। এই মা শব্দটির বিশালত্ব অসাধারণ, অপরিসীম ও অপরিমেয়।
‘মা’ অতি আবেগময়, অনুভূতিশীল ও ভাবপ্রবণ একটি শব্দ। উচ্চারণ অতি সহজ-সরল ও সাধারণ। এই শব্দের উচ্চারণে কোনো জটিলতা, দুর্বোধ্যতা ও অস্বচ্ছতা নেই। অনুভবেও কোনো অস্পষ্টতা, জড়তা, সীমাবদ্ধতা নেই। কিন্তু এই শব্দের দ্যোতনা, ব্যঞ্জনা ও প্রকাশ বিস্ময়কর। মা শব্দের অনুরণন, প্রতিধ্বনী ও ঝংকার অভাবনীয়, অচিন্তনীয় ও অকল্পনীয়।
পৃথিবীর যে-কোনো জাতির, যে-কোনো দেশের, যে-কোনো গোষ্ঠীর-সকল সন্তানের নিরাপত্তার প্রথম, প্রধান ও অদ্বিতীয় অনুভূতি মা। শুধু তাই নয়, মা হলো পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসার প্রাথমিক উৎস, আধার ও আকর।
পৃথিবীর সকল দেশেই কেবল এই ‘মা’ শব্দটি সর্বজনীন। মা প্রথম কথা বলা শেখান বলেই মায়ের ভাষাকে বলা হয় মাতৃভাষা। মা হচ্ছেন সন্তানের অস্তিত্বের ধারক, বাহক, ধ্রুবক ও সারথি। মা সন্তানের মায়া-মমতা-নিরাপত্তা-নিশ্চয়তা ও আশ্রয়। মা সন্তানের প্রথম অভিভাবক, শিক্ষক, পরিচালক ও প্রিয় বন্ধু।
মা, পৃথিবীর সর্বাধিক প্রচারিত, সর্বোচ্চ উচ্চারিত এবং সর্বোত্তম ব্যবহৃত শব্দ। শ্রুতিমধুর, মনোমুগ্ধকর ও মায়াময় এই শব্দের সঙ্গে অন্য কোনো শব্দের তুলনা হয় না। সন্তানের জীবনে মায়ের ভূমিকা অপার, অসীম ও সীমাহীন। মায়ের ওপর সন্তান এতটাই নির্ভরশীল যে, সন্তান কোনো আপদে-বিপদে, আনন্দ-উল্লাসে মনের অজান্তেই মাকে ডাকে। উচ্চারণ করে ‘ওমা’/‘মাগো’।
সন্তানের সকল মুসকিল আসান করে মা। আবার সন্তানের যে কোনো সাফল্যে সবচেয়ে খুশি হয় মা। সন্তানের মুখে মা ডাক শুনে বিমোহিত, বিহব্বল ও অভিভূত হন যে কোনো নারী। লাভ করেন সর্বোচ্চ সম্মান, শ্রদ্ধা ও মর্যাদা।
পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হওয়ার পরেই সন্তান সবার আগে পায় মায়ের স্পর্শ, ছোঁয়া ও পরশ। একইসঙ্গে মমতা, ভালোবাসা, আদর ও স্নেহ। মাতৃস্নেহের এই আবেগঘন পরশের স্নিগ্ধ, সতেজ ও কোমল অনুভূতি পৃথিবীর সবকিছুর উর্ধ্বে। নিজের সুখ, শান্তি ও স্বস্তি বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে বড় করার, মানুষ করার ও প্রতিষ্ঠিত করার সার্বক্ষণিক চেষ্টা করেন মা। সন্তানের মঙ্গল কামনায় মায়ের ধৈর্য-সহ্য ও সাহস এবং ত্যাগ-তিতিক্ষা ও প্রচেষ্টার অন্ত নেই। মা সন্তানের জন্য নিজের অস্তিত্বকে বিক্ষিপ্ত, বিদীর্ণ ও বিলীন করে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না।
প্রাণী জগত সৃষ্টির সেই আদি লগ্ন থেকেই স্নেহময়ী, মমতাময়ী ও করুণাময়ী মা-সকল প্রাণ সৃষ্টির আধার, প্রকৃতির শ্রেষ্ঠতম অব্যয়, অক্ষয় ও অবিনাশী অবয়ব। মা ছাড়া প্রাণ সৃষ্টি, প্রকাশ ও বিকাশের কোনো দ্বিতীয় মাধ্যম নেই।
মা ছাড়া জগতের কোনো প্রাণীরই প্রাণ ধারণ, অস্থি-মজ্জা সৃষ্টি, পুষ্টি ও পূর্ণতা এবং জন্মগ্রহণ ও লালন, পালন সম্ভব না। গর্ভধারিণী মায়ের উদর সন্তানের শ্রেষ্ঠ আবাস-আশ্রয় ও সুরক্ষা কবচ। সন্তান বেড়ে ওঠে মায়ের বুকে-পেটে-হাতে-কোলে-পিঠে-নয়নে-মস্তকের সমন্বিত প্রচেষ্টায়। অপার, অসীম ও অশেষ স্নেহ-মায়া-মমতায়। অঢেল, অজস্র ও অপরিমেয় আদর-প্রীতি-সোহাগে। মায়ের অফুরন্ত স্বপ্ন, সাধ ও আশার আলোর স্রোতে। অসম্ভব আশা, আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার প্রত্যয়ে, সাহস-নির্ভয়-নির্ভিকতায়।
সন্তানের চিরদিনের নিরাপত্তা, নির্বিঘ্নতা, নির্ভরতা, আশা, ভরসা ও আস্থার প্রতীক মা। মায়ের বুকেই সন্তানের পরম সুখ-শান্তি ও স্বস্তির কোমল পরশ। সন্তানের সর্বসুখের দিশা, আবাস ও ঠিকানা মা। মায়ের মতো এতো মহৎ, উদার ও নিঃস্বার্থ জগতে আর কেউ নেই। এমন নির্লোভ, নির্মোহ, নিরাপদ ও নির্মল ভালোবাসার আগার ত্রিভূবনের কোথাও নেই।
মায়ের মতো শুভাকাঙ্খী, শুভানুধ্যায়ী, হিতাকাঙ্খী জগতে আর কেউ নেই। সন্তানের জন্য মায়ের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও ধৈর্য অপরিমেয়। মায়ের সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহিষ্ণুতা ও ক্ষমার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। মায়ের মতো মানবিক, মনুষ্যত্বপূর্ণ, মনুষ্যোচিত, মনুষ্যসুলভ ও লোকহিতকর হৃদয় পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তাই তো কবি কাজী কাদের নেওয়াজ তাঁর ‘মা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই, মায়ের চেয়ে ত্রিভুবনে আপন কেহ নাই’। (চলবে)
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।