দ্যুতিময় বুলবুল
সপ্তম পর্ব
সোমেন জানায়, কল্যাণী তাকে বলেছিল-কোনো দিন সে আর বিয়ে করবে না। আজও সে শুধু আমাকেই ভালোবাসে এবং আমাকেই স্বামী হিসেবে মানে। কল্যাণীর এসব কথা শোনার পর, আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ি। তারপর আর স্থির থাকতে পারিনি। ভাবলাম, কল্যাণীর জীবন নষ্ট হবে, আর আমি নিজে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকব, এটা হয় না।
সোমেন বলতে থাকে, মুহূর্তের মধ্যে আমার জীবনের সমস্ত ছক ওলট-পালট হয়ে গেল। ভাবলাম, কল্যাণীর জীবন আমি ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। তার জীবন ধ্বংসের দায় আমি নিবো না। তাকে হারাতেও পারবো না। হারতেও দেবো না। কিছুতেই না। তাই দিনের পর দিন অনেক ভেবে-চিন্তে সব সময় কল্যাণীর পাশে থাকার প্রস্তাব দিলাম। কিন্তু এতে আমার সংসার জীবনে প্রভাব পড়বে। তাই কল্যাণী কিছুতেই আমার সুখের সংসার ভাঙতে বা আমার স্ত্রী-সন্তানের জীবনে অশান্তি আনতে রাজি ছিল না। ফলে আমি তার কাছে আমার স্ত্রী-সন্তানকে বুঝানোর দায়িত্ব নেওয়ার ওয়াদা করি। তারপরও কল্যাণী চরম আপত্তি ও তীব্র বিরোধিতা করে। তবুও আমি কল্যাণীর বাধা মানি নি।
কিন্তু এক পর্যায়ে উপলব্ধি করলাম, আমাদের সমাজে একজন বিবাহিত পুরুষ এবং একজন সিঙ্গেল নারীর দিনের পর দিন একসঙ্গে মেলামেশা করা শোভন না। তার প্রমাণ, কল্যাণী ও আমাকে নিয়ে ইতোমধ্যেই ঘরে-বাইরে নানা গুঞ্জণ-গুজব, সন্দেহ-সংশয়, প্রচার-প্রপাগাণ্ডা শুরু হয়েছে। অফিসের সামনে-পেছনে, গোপনে-এমনকি প্রকাশ্যেও, নানা মুখরোচক আলোচনা-সমালোচনা এবং টিকা-টিপ্পনী চলছে। যা দু’জনের জন্যই অসম্মানজনক ও অস্বস্তিকর।
এমকী, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও এর প্রভাব পড়ছে। আমার লাইফস্টাইলও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। শ্যামলী, তুমি নিজেই তার সাক্ষী। একজন নিয়মের মানুষ আমি, অথচ আজকাল কত অনিয়ম করি। শুধু তাই নয়, একটা অপরাধবোধও কাজ করছিল। তাই অনেকটা জোর করেই গোপনে কল্যাণীকে বিয়ে করেছি, পুরোহিত ডেকে। এই বিয়ের দায় কল্যাণীর না, পুরোটাই আমার। শ্যামলী, তুমি যে শাস্তিই আমাকে দিতে চাও, দাও। আমি আপত্তি করবো না।
সোমেনের দাবি, কল্যাণীর সঙ্গে তার প্রেম খাঁটি। এই সম্পর্ক কোনোভাবেই পরকীয়া নয়। তার কথায়, পরকীয়া (Adultery বা Extramarital affair অথবা Extramarital sex) বলতে আমরা সাধারণত বিয়ের পর অবৈধ সম্পর্ককে বুঝি। বিবাহিত কোনো নারী কিংবা পুরুষ যদি নিজের বৈধ স্ত্রী বা স্বামী থাকা সত্ত্বেও, অন্য কারো প্রতি আসক্ত হয়, কোনো প্রেমের সম্পর্ক বা যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়, তবে সেটাকে পরকীয়া প্রেম বলে।
সোমেন বলে, আমি জানি-পারিবারিক ও দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতিতে পরকীয়া প্রেম প্রবল প্রভাব ফেলে। সমাজে পরকীয়া সম্পর্ককে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে এ ধরনের সম্পর্কে জাড়ানোকে ব্যভিচার হিসেবে গণ্য করা হয়। সারা পৃথিবীতেই এখনো পরকীয়ার সম্পর্ককে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। এ নিয়ে হাসি-তামাশা এবং নানা বিরূপ মন্তব্যও করা হয়।
কিন্তু আমি তো কল্যাণীর সঙ্গে পরকীয়া করছি না। তাই সেটা নিয়ে ভাবছিও না। যদিও বিশ্বের অনেক মানুষ পরকীয়া প্রেমে অভ্যস্ত। মানব সমাজে আদিকাল থেকেই পরকীয়া চলছে। এমনকী, বিশ্বব্যাপী নানা পৌরাণিক কাহিনিতে দেব-দেবী এবং জগৎ বিখ্যাত অনেক ব্যক্তির জীবনে পরকীয়া প্রেমের উদাহরণ ভুরি ভুরি।
সোমেন কল্যাণীর সঙ্গে তার সম্পর্ককে একটি নির্দোষ স্বাভাবিক প্রেম হিসেবে অভিহিত করে। তার দাবি, কল্যাণী আমার প্রথম প্রেম, শ্যামলী দ্বিতীয়। মানুষের জীবনে একটি প্রেম ভেঙে গেলে, আর একটি প্রেম তো আসতেই পারে। তবে ভেঙে যাওয়া প্রেম দীর্ঘদিন পর জোড়া লাগাটা অস্বাভাবিক ও অভাবনীয়, বিশেষ করে দ্বিতীয় প্রেম বা বিয়ের পর।
সোমেনের দাবি, আমি কাউকে হারাতে চাই না। ত্রিভুজ প্রেমের মিলন চাই। সমাজে একাধিক বিয়ে তো নতুন কিছু নয়। অস্বাভাবিকও নয়। তার কথা, প্রকৃতির সব কিছু তো ভালোবেসে পাশাপাশি থাকছে, কোনো সংঘাত-সংঘর্ষ ও হিংসা-বিবাদ ছাড়াই। এমনকি দাম্পত্য জীবনে খোঁটাখুঁটি থাকলেও, অনেকে একসঙ্গে বসবাস করছে। তবে আমরা কেন পারবো না?
সোমেন নানা যুক্তিতে তার কৃতকর্মকে বৈধতা দিতে চেষ্টা করলেও, মুখোমুখী হয়ে আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। অপরাধবোধে জর্জরিত সোমেন জানালা দিয়ে ঘরের বাইরে লাখো-কোটি নক্ষত্র সজ্জিত আলো ঝলমল সূদুর আকাশে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে, শত আলোকবর্ষ দূরে।
রাতের শুভ্র-স্বচ্ছ ও মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়েই এক পর্যায়ে সোমেন আমাকে বলল, শ্যামলী-সবকিছুই তোমাকে খুলে বললাম। ভুল-শুদ্ধ যাই করি, আমার আর ফেরার পথ নেই। এখন সিদ্ধান্ত তোমার। এই ত্রিভুজ সম্পর্কের ভবিষ্যত তোমার ওপর নির্ভর করছে। তুমি চাইলে যেমন আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারো। আমাকে ত্যাগ করতে পারো। তেমনি মান-অভিমান না করে কিম্বা ঝগড়া বিবাদে না গিয়ে, ত্রিভুজ প্রেমের এই সম্পর্কটা মেনে নিয়ে দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে মহত্বের একটি নজীর সৃষ্টি করতে পারো। কারণ, আমি শ্যামলীকেও চাই, কল্যাণীকেও চাই। দু’জনেই আমার প্রেম, আমার জীবনের অংশ।
সোমেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করে, আমি সত্যিই তোমাদের দু’জনকেই শতভাগ ভালোবেসেছি। তোমাদের দু’জনের সঙ্গে আমার প্রেম পৃথক সময়ে, পৃথক স্থানে। কাউকে ফাঁকি দেইনি, বাদও দেইনি। যখন তোমার সঙ্গে প্রেম শুরু, তখন কল্যাণী অতীত। যখন কল্যাণী ছিল বাস্তব, তখন তুমি ছিলে কল্পনাতীত। তাই তোমাকে ঠকানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। কল্যাণীও এক সময় আমার জীবন থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। আমি তাকে ত্যাগ করিনি। যখন যাকে ভালোবেসেছি মন থেকেই ভালোবেসেছি। কাউকেই ঠকাতে চাইনি। তোমরাও কেউ আমাকে ঠকাওনি।
তবে আজকে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, এটা আমি কোনো দিন ভাবিনি। এমন একটা অস্বস্তিকর ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি আমাদের কারোই কাম্য নয়। কিন্তু এই সংকটের সমাধান কী, আমি জানি না। তবে তোমাকে বলতে পারি, আজকে কল্যাণীর সঙ্গে প্রেম যতটা সত্য, তার চেয়েও অনেক বেশি সত্য আমি নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব পালন করেছি। বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে অন্তর-আত্মার ডাকে সাড়া দিয়েছি।
আমি জানি, এ ঘটনা পরিবার-পরিজন আত্মীয় স্বজন এবং সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। আমরা তিনজনেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বো। ফলে পরবর্তী পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা আমি নিশ্চিত নই। বিশেষ করে আমাদের সন্তান এবং আমাদের তিনজনের পরিবার ও কাছের মানুষরা কীভাবে নেমে আমি জানি না। তবে তুমি যদি আমার পাশে থাকো, আমি সব পরিস্থিতি মোকাবেলা করবো। (চলবে)
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।