দ্যুতিময় বুলবুল
আজ ১৮ এপ্রিল ২০২৪, রোজ বৃহস্পতিবার, সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের (Albert Einstein) ৬৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই মহান বিজ্ঞানী আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দুটি স্তম্ভের একটি) এবং ভর-শক্তি সমতুল্যতার সূত্র, E=mc2 (‘বিশ্বের সবচে’ বিখ্যাত সমীকরণ’ হিসেবে খেতাব জয়ী) আবিষ্কার করে বিজ্ঞান চিন্তার এক বিস্ময়কর জগত সৃষ্টি করেন। আর এই অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য তিনি ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
বিশ্ববিখ্যাত নোবেলজয়ী এই পদার্থবিজ্ঞানী ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল শুক্রবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডভান্সড স্টাডির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রচুর গবেষণা করেছেন এবং নতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারে তাঁর বিশাল অবদান। আইনস্টাইনের গবেষণাকর্মসমূহ বিধৃত রয়েছে ৫০টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র এবং কিছু বিজ্ঞান-বহির্ভূত পুস্তকে।
আইনস্টাইন ব্রাউনীয় গতি, আলোক তড়িৎ ক্রিয়া, আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব এবং শক্তি ও জড়তার সূত্র ইত্যাদি জগৎ বিখ্যাত সূত্রের আবিষ্কারক। তবে তাঁর (Einstein) বহু বৈচিত্র্যময় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আপেক্ষিক তত্ত্ব। তাই এই আপেক্ষিক তত্ত্বের জন্য তিনি সমধিক পরিচিত।
আলবার্ট আইনস্টাইনের ‘আপেক্ষিক তত্ত্ব বা Theory of Relativity এবং তাঁর ভরশক্তি সমতুল্যতার সূত্র পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত সমীকরণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সে কারণে ‘আলোর তড়িৎ ক্রিয়া সম্পর্কিত গবেষণার জন্য আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন, ১৯২১ সালে। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান এবং বিশেষত আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া সম্পর্কীত গবেষণার জন্য তাঁকে এই নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।
মহাবিশ্ব এবং মহাজাগতিক ঘটনা সম্পর্কে মানুষের ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন আলবার্ট আইনস্টাইন। বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে ‘জিনিয়াস’ ব্যক্তি তিনি। তাঁর মতো জিনিয়াস পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ নেই। আর কেউ আসবেন কি না, সে নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
অনেকে মনে করেন, আইনস্টাইন যা ভেবেছেন, তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে যা কিছু ঘটেছে, তা এক কথায় মানুষের পক্ষে অকল্পনীয়। তিনি আসলে ‘জিনিয়াস’ হয়েই জন্মেছিলেন। আইনস্টাইনের মৌলিক কাজের সংখ্যা, বৈচিত্র্য এবং অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনা করে তাঁকে সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে অভিহিত করা হয়।
১৯৯৯ সালে টাইম সাময়িকী আইনস্টাইনকে “শতাব্দীর সেরা ব্যক্তি” হিসেবে ঘোষণা করে। এছাড়া বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের ভোটেও, আইনস্টাইন সর্বকালের সেরা পদার্থবিজ্ঞানীর স্বীকৃতি লাভ করেন।
পৃথিবীর সেরা এই পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ শুক্রবার, জার্মানির দানিউব নদীর তীরে উল্ম শহরে, রেলস্টেশন রোড–বানহফস্ট্রাসের ২০ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায়, ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্টে। গত ১৪ মার্চ, ২০২৪ পালিত হয়েছে তাঁর ১৪৫তম জন্মদিন।
একটি ধর্মনিরপেক্ষ মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে আইনস্টাইনের জন্ম। তাঁর বাবার নাম ছিল হেরমান আইনস্টাইন। মূলত তিনি পাখির পালকের বেড তৈরি করে বাজারজাত করতেন। তাঁর মা পলিন ছিলেন গৃহিনী। পলিন ও হেরমান আইনস্টাইনের প্রথম সন্তান ছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর একটি ছোট বোন ছিল, নাম মাজা। আইনস্টাইনের জন্মের দুই বছর পর তাঁর জন্ম হয়।
জার্মানির উলম শহরে জন্ম হলেও, পরবর্তীতে আইনস্টাইনের পরিবার উলম ছেড়ে মিউনিখ শহরে চলে যায়। সেখানে আইনস্টাইনের বাবা হেরমান তাঁর ছোট ভাই জ্যাকবের সঙ্গে একমুখী বিদ্যুৎ নির্ভর বৈদ্যুতিক যন্ত্র নির্মাণের একটি কারখানা স্থাপন করেন। এতে তাঁরা মোটামুটি সফলতা পান। ফলে আইনস্টাইনের শৈশব কাটে মিউনিখে।
১৮৭৯ সালে জন্মের সময় থেকেই, আলবার্ট আইনস্টাইনের মাথাটা অস্বাভাবিক বড় ছিল। তাঁর মাথার পেছন দিকে ছিল অস্বাভাবিক উঁচু। তাই অদ্ভূত মাথামোটা ছেলেটার বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু হবে কি না, তা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলেন তাঁর মা-বাবা। বিশেষ করে তাদের চিন্তা আরও বেড়ে যায়, যখন তাঁরা দেখেন আড়াই বছর বয়সেও আইনস্টাইন কথা বলতে শিখলেন না।
আলবার্ট আইনস্টাইনের স্কুলজীবন শুরু হয় ১৮৮৫ সালের ০১ অক্টোবর। মিউনিখে বাড়ির কাছে একটি স্কুলে তিনি ভর্তি হন। তার এই প্রথম স্কুলটি ছিল ক্যাথলিক এলিমেন্টারি স্কুল। আইনস্টাইন পাঁচ বছর বয়সে এই ক্যাথলিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
ক্লাসের ৭০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে শুধু আইনস্টাইন ছিলেন ইহুদি। এজন্য সহপাঠীরা তাকে নানাভাবে নির্যাতন করতো। ফলে ওই স্কুলে আইনস্টাইনের কোনো বন্ধু ছিল না। তাছাড়া, স্কুলের পড়াশোনার পদ্ধতি ভালো লাগতো না আলবার্ট আইনস্টাইনের। তাই তিনি স্কুলের ক্লাসের পড়াশুনায় তেমন মনোযোগী ছিলেন না। শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তরও ঠিকমতো দিতেন না। বাকপটুতা না থাকলেও তিনি এলিমেন্টারি স্কুলের সেরা মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ক্যাথলিক স্কুল জীবনেও আইনস্টাইনের কথা বলার ক্ষমতা খুব একটা ছিল না। এই স্কুলে তিনি তিন বছর পড়াশোনা করেন।
আট বছর বয়সে আইনস্টাইনকে লুইটপোল্ড জিমনেসিয়ামে (বর্তমানে আলবার্ট আইনস্টাইন জিমনেসিয়াম নামে পরিচিত) ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি উন্নত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ওই স্কুলে তাঁর পরীক্ষায় ফলাফল ছিল বেশ ভালো।
তবে স্কুল তাঁর ভালো লাগতো না। গঁদবাধা পড়ালেখায় মন বসতো না। আইনস্টাইন সে সময়ের পরীক্ষা পদ্ধতিও মেনে নিতে পারেন নি। আইনস্টাইন চাইতেন স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে। মুক্ত চিন্তার মাধ্যমে শিখতে। কিন্তু শিক্ষকরা তাঁর ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই বেয়াড়া ও অমনোযোগী ছাত্র আইনস্টাইনকে উদ্দেশ্য করে তাঁর এক শিক্ষক বলেছিলেন যে, তাকে দিয়ে মহৎ কিছু হবে না। কিন্তু পরবর্তীতে আইনস্টাইন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। (চলবে)
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।