নুসরাত ফারিয়ার ‘হাসিনা’ হয়ে ওঠার গল্প

Spread the love

‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্র

দ্যুতিময় বুলবুল

বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী  নুসরাত ফারিয়া ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার ‘ চলচ্চিত্রে ‘শেখ হাসিনা’ চরিত্রে অভিনয় করে সর্বমহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ফারিয়ার অভিনয়ে খুশি হয়ে তাঁকে প্রশংসা করেছেন। তাঁর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নুসরাত ফারিয়াকে আলাদা করে কিছু ‘টিপস’ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কী বলেছিলেন শেখ হাসিনা?

২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রে নিজের লুক প্রথমবারের মতো ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ করেন নুসরাত ফারিয়া। ছবিতে তাঁর পরনে ছিল সাদা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা। গলায় সোনার গয়না ও হাতে একটি লাল গোলাপ। নতুন লুকের সঙ্গে ক্যাপশনে অভিনেত্রী লিখেছিলেন, “তার বিয়ের সময়ে। ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ মুক্তি পাবে আগামী ১৩ অক্টোবর।’

প্রধানমন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন এবং প্রথম আলোর বিনোদন বিভাগের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন নুসরাত ফারিয়া। সিনেমাটি মুক্তির আগে অভিনেত্রী ফারিয়া আনন্দবাজারকে বলেছিলেন, “প্রথম প্রস্তাব আসা থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত খুব সুন্দর একটা সফর শেষ করলাম। সকলে এতো পরিশ্রম করে সিনেমাটা তৈরি করেছেন। সেটা এবার মুক্তি পাচ্ছে, ভেবেই আমার ভালো লাগছে।’

শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি বলে আনন্দবাজারকে জানিয়েছিলেন নুসরাত ফারিয়া। তিনি বলেছিলেন, “জানার পর নিজেকে আমার দেশের সব থেকে সৌভাগ্যবান মানুষ মনে হয়েছিল। কারণ, এর আগেও কেউ কখনো পর্দায় তাঁর (শেখ হাসিনার) চরিত্রে অভিনয় করেননি। ভবিষ্যতে কেউ করবে কি না সেটাও জানি না।

ফারিয়া বলেন, “আমার তো মনে হয় ভবিষ্যতে যদি আর কোনোদিন অভিনয় না করি, তাহলেও এই চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ অর্জন করেছি, সেটাই আমার কাছে পরম প্রাপ্তি।’ তাঁর চরিত্রে নুসরাত ফারিয়ার অভিনয়ের কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জানতেন। এ নিয়ে এক সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথাও হয়েছিল বলে জানান ফারিয়া।

শেখ হাসিনা তাঁকে কোনো পরামর্শ দিয়েছিলেন কিনা, এই প্রশ্নের জবাবে নুসরাত ফারিয়া বলেছিলেন, “উনি আমাকে কনফিডেন্ট রাখতে বলেছিলেন। আর বলেছিলেন, আমার মতো করে চরিত্রটাকে ফুটিয়ে তুলতে।’

এদিকে, প্রথম আলোর বিনোদন বিভাগে আজ ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রোজ শনিবার এক সাক্ষাৎকারে ফারিয়া বলেন, এই সিনেমায় শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাওয়াটাই আমার কাছে একটি বিরাট প্রাপ্তি। এবং যখন এটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে, পর্দায় যখন দেখতে পেরেছি, তখন কিন্তু আসলে দ্যা ফুলফিলমেন্ট ওয়াজ কমপ্লিটলি ডিফারেন্ট।’

তিনি বলেন, যখন দেখেছি আমার লুক অনেক বেশি মানুষ পছন্দ করেছে। বিয়ের লুকটা স্পেশালি। এবং পরো সিনেমাতে সবাই বলেছেন, আসলেই ফুটিয়ে উঠাতে পেরেছি। এই ব্যাপারগুলো, আসলে এপ্রেসিয়েশনগুলো কিন্তু অনেক অনুপ্রেরণাদায়ক লাগে। দ্য ফিলিং ইজ রিয়ালি গুড। এখনো ওই ফিলেই আছি বলা যায়।

গতকাল ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ শনিবার, ফারিয়া প্রথম আলোকে বলেন, আমি যদি বলি হাসিনা ওই ছবিতে মোস্ট লাভার, স্মার্ট। ইভেন দো দেয়ার ওয়াজ নো মেকআপ, নো হেয়ার, নাথিং, বাট আই ফেল লাইক-আচ্ছা আমি তো কোনো মেকাপ-ই করিনি। তবুও আমাকে খুব সুন্দর লাগছে। মূলত ওই চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব সব কিছু মিলিয়েই আর কি –।

ফারিয়া বলেন, এটা খুব কঠিন ছিল-তবে যখন ক্যারেক্টরে ধারণ হয়ে যায়- ওই বড় উইকটা, কন্টাক্ট লেন্স, ওই শাড়ি, ওই পুরো জিনিসটার মধ্যে যখন তুমি ঢুকে যাও, তখন সব কিছু আসলে সহজ হয়ে যায়। আর সবাই যখন সেটে তোমাকে হাসিনা হাসিনা করে ডাকে, তখন সেই উপলব্ধিটা অনুভূত হয়।

ফারিয়া বলেন, সিনেমার শুরুতে তাঁর (শেখ হাসিনার) সঙ্গে তো কথা হয়েছে। সিনেমা যেদিন রিলিজ হয়েছে, সেদিন তো তাঁর সঙ্গে পাশে বসে দেখার সুযোগটা হয়েছে, সৌভাগ্য হয়েছে। হোয়েন সি হোল্ড মাই হ্যান্ড, সি প্রেসড মি। সেটা ছিল আমার জন্য অনেক বড়-বড় মুহূর্ত।

শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কী কথা হয়েছিল এবং তাঁর কাছ থেকে ফারিয়া কী টিপস পেয়েছিলেন, হাসিনা হওয়ার জন্য-এমন এক প্রশ্নের জবাবে অভিনেত্রী বলেন, আমাকে শুধু এতো টুকুই বলা হয়েছিল যে, জাস্ট বি ইউরসেল্ফ। এ্যান্ড কনফিডেন্টলি করবে, যেটাই করো। ইট হেলপ মি সো মাচ। আমার কাছে মনে হয় আর দশটা মেয়ের মতোনই হাসিনা। যদিও তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী। আদার দেন দ্যাট, আমি যে চরিত্রটা প্লে করেছি, সেটা কিন্তু বাঙালি আর দশটা মেয়ের মতো। যে অনেক ইমোশনাল, সি ইজ ভেরি সফট হার্টেট। এ্যান্ড কথায় কথায় কান্না করে দেয়। এ্যান্ড ভেরি সফট স্পোকেন। এবং পরিবারের সবার জন্য তাঁর অনেক ভালোবাসা রয়েছে।

তিনি বলেন, আমার মনে হয় বাঙালি প্রত্যেকটি মেয়ের মধ্যে এই গুণগুলো রয়েছে। সি ইজ নট ডিফারেন্ট ফ্রম এনি ওয়ান এলস। প্রত্যেকটা মেয়ের মধ্যেই একজন হাসিনা রয়েছেন। যেটা আমি অনুভব করেছি।

ফারিয়া বলেন, হোয়েন আই প্লেড ড্যাট ক্যারেক্টর, ইজ দিস আমার কাছে ওই ইমোশনটাকে ক্যারি করতে হয়েছে। যে আমি রিপ্রেজেন্টেটিং এন্টায়ার ওমেন অব বাংলাদেশ। সো হোয়েন আই কিপট দ্যাট ইন মাই মাইন্ড এ্যান্ড ইট ওয়াজ ভেরি প্লেইন এ্যান্ড সিম্পল।

২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর বৃহস্পতিবার, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে সিনেমাটির প্রিমিয়ার শো উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে প্রধানমনন্ত্রী বলেন, “আগামীকাল (১৩ অক্টোবর) পুরো বাংলাদেশে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ ছবিটি মুক্তি পাবে। দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান থাকবে, ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য আপনারা জানতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পারবেন। আমার মা, আমার দাদা দাদির সম্পর্কে আপনারা জানতে পারবেন। আমি আশা করি সবাই ছবিটি দেখবেন। ইতিহাসের নতুন অধ্যায় আপনারা দেখতে পারবেন।”

১৩ অক্টোবর শুক্রবার বাংলাদেশের ১৫৩টি সিনেমা হলে মুক্তি পায় ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হওয়ায় ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ আর ভারতের ৪০ শতাংশ ব্যয়ে নির্মিত এ বায়োপিকের শুটিং ভারতের মুম্বাই ফিল্ম সিটিতে শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের ২২ জানুয়ারি। শেষ হয় একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নির্ভর সিনেমা ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছে গত বছর ২০২৩ সালের ১৩ অক্টোবর ও ভারতে মুক্তি পায় ২৭ অক্টোবর।

গত বছর ২০২৩ সালের ১৩ অক্টোবর সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলেও, ২০২২ সালের ১৯ মে ফ্রান্সে ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটির প্রাথমিক ট্রেলার মুক্তি পায়। এরপর ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পায়। ২০২০ সালে সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর, বাংলাদেশে শুটিং শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, করোনা মহামারির কারণে শুটিং পিছিয়ে যায়। এক বছর পর ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি মুম্বাইয়ের দাদাসাহেব ফালকে ফিল্ম সিটিতে সিনেমাটির শুটিং হয়।

বহুল আলোচিত এই সিনেমায় বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরিফিন শুভ, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা, শেখ হাসিনার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নুসরাত ফারিয়া এবং শেখ রেহানা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাবিলা নূর। এছাড়া ছোট রেনু চরিত্রে ফারদিন দীঘি, কিশোরী শেখ হাসিনা চরিত্রে ওয়ানিয়া জারিন আনভিতা ও কিশোরী শেখ রেহানা চরিত্রে সামান্তা রহমান।

বঙ্গবন্ধুর মা শেখ সায়েরা খাতুনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিলারা জামান, বাবা লুৎফর রহমান চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী,খায়রুল আলম সবুজ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চরিত্রে তৌকির আহমেদ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী চরিত্রে দীপক আন্তানি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম চরিত্রে সায়েম সামাদ, তাজউদ্দীন আহমদ চরিত্রে রিয়াজ,কামারুজ্জামান চরিত্রে সমু চৌধুরী, মনসুর আলী চরিত্রে খলিলুর রহমান কাদেরি, শেখ কামাল চরিত্রে কামরুল হাসান, শেখ জামাল চরিত্রে শরীফ সিরাজ, মেজর জেনারেল ওসমানী চরিত্রে খন্দকার হাফিজ, জিয়াউর রহমান চরিত্রে একে আজাদ সেতু, খন্দকার মোশতাক চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু, কিশোর মুজিব চরিত্রে দিব্য জ্যোতি, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ, এ কে ফজলুল হক চরিত্রে শহীদুল আলম সাচ্চু, আব্দুল হামিদ চরিত্রে গাজী রাকায়েত, জেনারেল আইয়ুব খানের চরিত্রে মিশা সওদাগর, টিক্কা খানের চরিত্রে জায়েদ খান, বেগম খালেদা জিয়া চরিত্রে এলিনা সহ আরো অনেক বাংলাদেশি অভিনয় শিল্পী এই ছবিতে অভিনয় করেছেন।

এছাড়া সিনেমাটিতে ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন শ্রীজা ভট্টাচার্য, রাজেন মোদি, দেবাশীষ নাহা, সোমনাথ, কৃষ্ণকলি গাঙ্গুলি, আবির সুফি, অরুণাংশু রায়সহ আরো অনেক।

বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি এই তিনটি ভাষায় ২ ঘণ্টা ৫৮ মিনিটের এই সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন বিখ্যাত ভারতীয় পরিচালক শ্যাম বেনেগল। ছবিটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন শামা জাইদি ও অতুল তিওয়ারি।

জানা গেছে, ৮৩ কোটি টাকা বাজেটে সিনেমাটি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করেছে। সিনেমাটির প্রযোজনা করেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন ‘বিএফডিসি’ ও ভারতের ‘এনএফডিসি’। চলচ্চিত্রটি দেশে-বিদেশি বিপুল প্রশংসিত হয়েছে।

কারণ, ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ শুধু একটি সিনেমা নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসের অমূল্য প্রামাণ্য দলিল। সিনেমাটির প্রতিটি দৃশ্যে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই ছবিটি বাংলাদেশের প্রথম কোনো বায়োপিক। এর আগে বাংলাদেশে কখনো কারো বায়োপিক নির্মিত হয়নি। ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সংগ্রামী জীবনী কাহিনি সিনেমার পর্দায় তুলে ধরা হয়েছে। মূলত এটি শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র নয়- এটি বাংলাদেশের ইতিহাস।

দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।