দ্যুতিময় বুলবুল
‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা’
আজ ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি, ২০২৪। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে, পাকিস্তানে নয় মাস ১৪ দিন কারাবাস শেষে, সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম বাঙালি জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে ফিরে আসেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭২ সালের ০৭ জানুয়ারি মধ্যরাতের পর, ৮ জানুয়ারি প্রথম প্রহরে-পাকিস্তানে বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পেয়ে, লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, বাঙালি জাতিসহ সারা বিশ্বের কাছে এক বিস্ময়কর ঘটনা। তাই লাখ লাখ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিকামী বাঙালি স্বাধীনতার মহানায়ককে এক নজর দেখার জন্য, তাঁর কথা শোনার জন্য-তেজগাঁও বিমানবন্দর, রেসকোর্স ময়দান ও সারা ঢাকা শহর-সহ দেশের সর্বত্র অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন।
শুধু ঢাকা বা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব গভীর আবেগ ও উৎসাহের সঙ্গে এই মহামানবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশায় ছিল। কখন স্বদেশের মাটিতে পদার্পণ করবেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক, আধুনিক বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
হয়তো এই মহামানবকে অভিবাদন জানানোর জন্যই, বাঙালির ত্রিকালদর্শী মহামানব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শেষ লেখা’ কাব্যে ‘ওই মহামানব আসে’ কবিতায় লিখেছেন-“ওই মহামানব আসে;/দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/মর্ত ধূলির ঘাসে ঘাসে।/সুরলোকে বেজে উঠে শঙ্খ,/নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক-/এল মহাজন্মের লগ্ন।/আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।/উদয় শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব/নব জীবনের আশ্বাসে।/জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়,/মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।”
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় এবং বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন পূর্ণতা লাভ করে। আর শত শত বছর ধরে লাঞ্ছিত এই পরাধীন জাতির পূর্ণ শক্তি ও সামর্থে কাঙ্খিত লক্ষে এগিয়ে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। একইসঙ্গে স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রোষ্টার স্বপ্নপূরণের পথ হয় অবারিত।
দিগ্বিজয়ী বীরের বেশে, স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি চিরকাল সশ্রদ্ধচিত্তে মনে রাখবে, স্মরণ করবে। কারণ, এই দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাঙালি জাতিও অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরে। হাজার বছরের পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেয়।
১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তিসনদ ছয়দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে, চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে পরিচালিত করেন। ফলে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী বাঙালি বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বের ওপর আস্থা রেখে তাঁর প্রদর্শিত পথে তীব্র লড়াই-সংগ্রাম শুরু করে। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির কাণ্ডারী হিসেবে এই লড়াইয়ে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
ফলে পাকিস্তানী সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু ও তাঁর অনুসারী বাঙালি রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে জেল-জুলুম এবং অত্যাচার-অবিচার বাড়িয়ে দেয়। একইসঙ্গে তারা বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে এই মামলায় জেনারেল আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে প্রবল গণ-অভ্যুত্থানে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকের বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় এবং বঙ্গবন্ধু সহ সকল রাজবন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। শুধু তাই নয়, গণঅভ্যুত্থানের জেরে স্বয়ং জেনারেল আইয়ুব খান তার সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন।
জেনারেল ইয়াহিয়া ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনের উদ্যোগ নেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে কেন্দ্রীয় পরিষদের প্রথম এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে দ্বিতীয় নির্বাচনে মুক্তিকামী বাঙালির পূর্ণ সমর্থনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক বেসামরিক শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসর ক্ষমতালোভী ও ষড়যন্ত্রকারী রাজনীতিকরা বাঙালিদের হাতে তথা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে। ফলে বাংলার জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এই অসহযোগ আন্দোলন চূড়ান্ত মুক্তির জন্য স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।
তাই বিক্ষুব্ধ বাঙালির স্বাধীনতার দাবি চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে হঠাৎ বাংলার নিরীহ, নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পরিকল্পিতভাবে নির্বিচারে ভয়াবহ নির্মম, নৃশংস, বর্বর ও পাষবিক গণহত্যা শুরু করে।
ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে (রাত সাড়ে ১২টায়) আনুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাসভরন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে ছয় দিন আটক রাখে।
এরপর ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে নিয়ে কারাবন্দি রেখে, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের জান্তা সরকার সামরিক আদালতে প্রহসনের সংক্ষিপ্ত গোপন বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী টানা নয় মাসের সশস্ত্রযুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পন করার পর, বাংলাদেশের বিজয়ী রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও দেশোদ্রোহিতার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যুদ্ধে পরাজিত প্রেসিডেন্ট হিয়াহিয়া খানের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
তাছাড়া বিশ্ব জনমতের প্রভাব তথা প্রভাবশালী সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের চাপ ও আন্তর্জাতিক আইনে বাধা এবং সর্বোপরি, ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি সেনাসদস্যদের প্রাণরক্ষার স্বার্থে ইয়াহিয়া পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়, বাংলাদেশের যুদ্ধজয়ের ২২ দিন পর, ০৭ জানুয়ারি রাত ৩টায়।
১৯৭২ সালের ০৭ জানুয়ারি মধ্যরাতের পর, বন্দি মুজিব মুক্ত হয়ে পাকিস্তান থেকে বিমানে ০৮ জানুয়ারি ভোরে লন্ডন পৌঁছেন। সেখানে রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ও বিরোধীদলীয় নেতা হ্যারল্ড উইলসনের সঙ্গে বৈঠক, সংবাদ সম্মেলন এবং প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ০৯ জানুয়ারি সকালে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানে স্বদেশের পথে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও জনগণের অভাবনীয় সংবর্ধনা শেষে, ওই দিনই দুপুরে স্বপ্নের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় নয় মাস ১৪ দিন পর বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন করেন, বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু। তখন সারা দেশে আনন্দ-উল্লাস। ঢাকা শহরে লাখো জনতার ঢল। বিমানবন্দর এলাকা লোকে লোকারণ্য। তিনি নিজেই তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’ (A Journey from darkness to light)।
এই সেই ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর, সাড়ে নয় মাস আগে যেখান থেকে পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ গভীর রাতে গোপনে কড়া পাহারায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্বদেশের বিমানে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে কারাগারে বন্দি করে।
তারপর পাকিস্তানের কারাগারে সামরিক ট্রাইবুন্যালে প্রহসনের গোপন বিচারে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহ তথা স্বাধীনতা ঘোষণা, বিদ্যমান সরকারকে অস্বীকার করা ও দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে চাপ দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৬৭টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিঠি দেন। অন্যদিকে তিনি ইউরোপের পাঁচটি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে বিশ্বজনমত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন। ফলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুকে তারা নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে লন্ডনে পাঠাতে বাধ্য হয়।
লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় ১০ জানুয়ারি দুপুর ১ টা ৪১ মিনিটে, তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছেন মহান বাঙালি রাষ্ট্রনায়ক ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাঙালি জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্রিটিশ রাজকীয় সম্মান ও শ্রদ্ধায়, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মধ্য দুপুরের তীব্র সূর্যালোকে ব্রিটিশ বিমান থেকে বঙ্গবন্ধু যখন অবতরণ করেন, তখন লাখো বাঙালি বিপুল শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসায় তাঁকে সিক্ত করেন। তারপর তাঁকে বরণ করা হয় মহান বিজয়ী বীরের সংবর্ধনায়। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল যেন রূপকথার নায়কের প্রত্যাবর্তন।
সমগ্র জাতি সেদিন সারাদেশে আনন্দ-উৎসবে মেতেছিল। সবার চোখে ছিল আনন্দ-অশ্রু। বঙ্গবন্ধুর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মিডিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধারণ করেছে। সারা বিশ্বে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছে সেদিনের সবচেয়ে আলোকিত বিষয়টিকে। সব গণমাধ্যমেরই উল্লেখযোগ্য সংবাদ ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ক’দিন পর, ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বলেছিলেন যে, তাঁর পাকিস্তান থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা। তার আগে, ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে দিল্লিতে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় ফেরা।”
সত্যিকার অথেই বঙ্গবন্ধুর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল, কল্পনার রূপকথার নায়কের বিস্ময়কর বাস্তবে প্রত্যাবর্তন। প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদণ্ড অকার্যকর করে, সসম্মানে মহান দিগ্বিজয়ী বীরের বেশে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল বাংলা ও বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন এবং বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস্য ক্যারেজমেটিক নেতৃত্ব, বিরল ব্যক্তিত্ব ও অসীম সাহসের নজিরবিহীন প্রকাশ।
তাই সমগ্র বাঙালি জাতি সহ পুরো ভারতবর্ষ সেদিন আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। ঘরে ঘরে মানুষ সেদিন হাসি খুশিতে মেতে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু সহ সারা জাতির চোখে ছিল মহামুক্তির আনন্দ-অশ্রু। স্বপ্নময় ভবিষ্যত নির্মাণের প্রত্যাশা তখন বাস্তবের অলিন্দে।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আনন্দময় দিনের প্রতিটি ক্ষণ সারাবিশ্ব গভীর আগ্রহ নিয়ে প্রত্যক্ষ করেছে। বাংলাদেশ তো বটেই, সারাবিশ্বের মিডিয়াগুলোও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধারণ করেছে মহান বিজয়ী বীরের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি ঘটনা এবং আনুষ্ঠানিকতা। একইসঙ্গে রেসকোর্স (সোহরাওয়াদী উদ্যান) ময়দানে প্রায় ১০ লাখ জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির স্বপ্নময় ভবিষ্যতের যে ঐতিহাসিক রূপরেখা তুলে ধরেন, তা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে।
বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালোবাসা ও দৃঢ় অঙ্গীকার এবং তাঁর প্রতি বাঙালির শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসা সারাবিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে নিবিড়ভাবে। তাই বিশ্বের সকল গণমাধ্যমে বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে সেদিনের সবচেয়ে আলোকিত বিষয় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। শুধু তাই নয়, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিশ্বের সকল গণমাধ্যমের প্রধান সংবাদ ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও তাঁর বিস্ময়কর দুঃসাহসী লড়াই-সংগ্রামের কাহিনী।
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।