দ্যুতিময় বুলবুল
চতুর্থ পর্ব
‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না —–’
প্রকৃতি ও জীবনের নিয়মে এই বিশ্ব চরাচরে কেউ কোথাও স্থির নয়। জীবন জীবিকার প্রয়োজন কিংবা প্রকৃতির পরিবর্তনের নিয়মে বিবর্তনের কালস্রোতে অমোঘ সত্যের কাছে হার তো মানতেই হবে। ভাবতে ভাবতে মায়ার দু’চোখ জলে ভরে গেল। নিরব, নিস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ সে।
মারুফেরও একই অবস্থা। কোনো কথাই বলতে পারছে না সে। শুধু মনে মনে স্মরণ করল, মান্নাদের সেই বিখ্যাত গান, “আবার হবে তো দেখা/ এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো —/কি চোখে তোমায় দেখি বোঝাতে পারিনি আজও হয়তো/ এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো।”
মারুফের কাছ থেকে শেষ বিদায়ের সময় কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল মায়ার। দু’চোখে তার অবিরাম বন্যা। মারুফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখল মায়া। মারুফও তাকে জড়িয়ে ধরল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এভাবে কেটে গেলো প্রায় পাঁচ মিনিট। এক পর্যায়ে সংযত হলো মায়া। মারুফের বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলো। আর আবেগে জড়াতে চাইলো না। কারণ, এতে শুধু দু’জনের কষ্টই বাড়বে। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে মারুফের কাছ থেকে বহু কষ্টে বিদায় নিলো মায়া। তার ধারণা, এটাই তাদের মুখোমুখি শেষ দেখা-শেষ বিদায়।
মায়া চাইলে মারুফকে সঙ্গে নিয়ে তার গাড়িতেই ঢাকায় ফিরতে পারতো। অথবা মারুফের গাড়িতে তার সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঢাকায় যেত। মারুফ সেই প্রস্তাবও করেছিল। কিন্তু মায়া রাজি হয়নি। কারণ, এখন যতই সে মারুফের সঙ্গে থাকবে, ততই দুর্বল হয়ে পড়বে। মারুফকেও দুর্বল করবে। এমন কি আবেগ-প্রবণ হয়ে মুখ ফসকে তাকে কিছু বলেও ফেলতে পারে। ফলে তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
তাই মনের বিরুদ্ধে সকল শক্তি প্রয়োগ করে, মারুফকে শেষ বিদায় জানিয়ে-মুক্তমঞ্চের সামনে থেকে দ্রুত বিদায় নিয়ে, সমাজবিজ্ঞান ভবনের সামনে রাখা গাড়ি পর্যন্ত দ্রুত হেঁটে গেলো মায়া। পিছন ফিরে একবারও তাকালো না। যদিও চোখে তার জলের ধারা বইছে নিরবধি। মারুফ মৃদু পায়ে হেঁটে এসে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে মায়ার পথের দিকে পলকহীন নেত্রে চেয়ে রইলো।
গাড়িতে ওঠার সময় শেষবারের মতো মায়া পিছন ফিরে মারুফের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় সম্ভাষণ জানালো। মায়ার বারবার মনে হচ্ছিল মারুফের সঙ্গে এটাই তার শেষ দেখা এবং শেষ বিদায়। বুকটা তার মোচড় দিয়ে উঠলো। তাই সে দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে পড়ল। মারুফ ম্লান বদনে অন্যমনস্ক হয়ে হাত উঁচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। মুহূর্তের মধ্যে মায়ার গাড়ি মারুফের চোখের দৃষ্টি সিমানার বাইরে চলে গেলো। মায়া পিছন ফিরে আর তাকাল না।
মায়া গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে তার প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটা একবার তাকে ঘুরে দেখাতে বলল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি বছর কাটিয়েছে সে। কত স্মৃতি, কত আনন্দ, কত বেদনা-সব মিশে আছে এই অপরূপ রূপসী প্রকৃতির মাঝে, সুন্দর আধুনিক স্থাপত্যে সাজানো গোছানো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কত ঘটনা-ই না মনে পড়ছে মায়ার। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, হইচই, উদাস দুপুরে গাছের ছায়ায় বসে গল্প-গুজব, ক্লাসরুমে বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি, বিশাল লাইব্রেরিতে বই নিয়ে বসে থাকা, জিমনেসিয়াম (Gymnasium) ও হলগুলোর মাঠে বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় টুর্নামেন্ট দেখা, লেকের ধারে বসে জলে ভাসা লাল পদ্ম, নীল পদ্ম সহ হরেক রকম ফুলের রূপের বাহার ও নানা দেশের রঙ-বেরঙের পাখি দেখা, কাঁঠাল বাগানে গোপন প্রেমে মজে থাকা, মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের পাতার গান শোনা, ক্যাফেটেরিয়ায় সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, বিকেলে দল বেঁধে পিচ ঢালা পথে হাঁটতে হাঁটতে গান গাওয়া, মুক্তমঞ্চে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করা, প্রান্তিক গেট বাজারে চায়ের টেবিলে নানা বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক সেরে সন্ধ্যায় ঢাকায় ফেরা- সবই এক এক করে সিনেমার মতো মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। মায়া আর নিজেকে সামাল দিতে পারছে না। ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে কাঁদতে। নীরব কান্না আর কত! বুক তো ফেটে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিনের ড্রাইভার রতন মায়ার কথামতো প্রতিটি রাস্তা ধরে ধরে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় চক্কর দিয়ে প্রান্তিক গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে, মায়ার নির্দেশে মফিজের চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়ালো। বহুদিন এখানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে মায়া। কত বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। আজও সেখানে মায়ার ক্লাসমেট স্নেহা ও রহিমসহ বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছে।
মায়া গাড়ি থেকে নেমে বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের টেবিলে প্রায় আধা ঘণ্টা আড্ডা দিলো। কারণ, মায়ার ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটাই তার শেষ আড্ডা। তাই সবার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলল সে। তারপর বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে ঢাকার পথে রওনা হলো। সাভার, হেমায়েতপুর, আমিনবাজার ও গাবতলী হয়ে ভিড় ঠেলে ঠেলে মায়া গুলশানে তাদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা প্রায় সাতটা বেজে গেলো।
বাড়িতে ঢুকতেই মায়াকে তার মা জানালেন, সিঙ্গাপুরের ভিসা হয়ে গেছে। রাতেই ফ্লাইট। এখনি সব কিছু গোছগাছ করে নাও। মায়া তার মায়ের এক নিঃশ্বাসে বলা কথাগুলো শুনল। কিন্তু কিছু বলল না। বুক তার ভেঙে যাচ্ছে, চোখ ফেটে কান্না আসছে। অথচ কিছুই সে বলতে পারছে না। তার বাবা মা-ও লুকিয়ে কাঁদছেন। মেয়ের কাছে কিছুই বলতে পারছেন না তারা।
ছোট্ট ভাইটা কিছু বুঝতে পারছে না। কিন্তু মায়ার তো আর কিছু বুঝার বাকি নেই। বাবা-মা এবং একমাত্র ছোট ভাই শান্তকে সে বারবার ফিরে ফিরে দু’চোখ ভরে দেখছে। ভাবছে আর হয়ত ক’দিন। তারপর সব শেষ।
মায়া তার ঘরে ঢুকে কাপড় না ছেড়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুই ভালো লাগছে না তার। মাথায় হাজারো দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বুঝতে পারছে না সে কী করবে। চোখ ফেটে জল আসছে তার। কাউকে কিছু বলতে পারছে না। অনিশ্চিত ভবিষ্যত। নিজের ভালো-মন্দ কিছুই বুঝতে পারছে না মায়া।
অন্য কারো সঙ্গে সে কী কথা বলবে? অন্তত মারুফকে কী বিষয়টি জানানো উচিত? ভাবে মায়া। কিন্তু মারুফকে বললে সে তো সহ্য করতে পারবে না। বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে। খারাপ কিছু হলে তো সে জানবেই। তাই এই শেষ মুহূর্তে আর কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী?
শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে পিয়ারি রূপী রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্তের কথা মনে পড়ল মায়ার। শ্রীকান্ত বলছেন,“ — যে গোপনেই আসিয়াছিল, তাহাকে গোপনেই যাইতে দিলাম। কিন্তু এই নির্জন নিশীথে সে যে তাহার কতখানি আমার কাছে ফেলিয়া রাখিয়া গেল, তাহা কিছুই জানিতে পারিল না। —– রাজলক্ষ্মীর জন্যই রাজলক্ষ্মীকে ছাড়িয়া যাইতে হইবে, তাহাতে আর কিছুমাত্র দ্বিধা করা চলিবে না।”
শ্রীকান্ত বলছেন, “—–নিঃশ্বাস ফেলিয়া পালকিতে উঠিয়া বসিলাম, দেখিলাম, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না—ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে। ছোটখাটো প্রেমের সাধ্যও ছিল না—এই সুখৈশ্বর্য-পরিপূর্ণ স্নেহ-স্বর্গ হইতে মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য, আমাকে আজ একপদও নড়াইতে পারিত। বাহকেরা পালকি লইয়া স্টেশন-অভিমুখে দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। মনে মনে বারংবার বলিতে লাগিলাম, লক্ষ্মী, দুঃখ করিয়ো না ভাই, এ ভালোই হইল যে, আমি চলিলাম। তোমার ঋণ ইহজীবনে শোধ করিবার শক্তি আমার নাই।”
পর্ব – ১
https://www.facebook.com/photo/?fbid=6753037561438754&set=a.1174050462670853
পর্ব – ২
https://www.facebook.com/photo?fbid=6784968824912294&set=a.1174050462670853
পর্ব – ৩
https://www.facebook.com/photo/?fbid=6859213270821182&set=a.1174050462670853