বলিভিয়ায় অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ, বরখাস্ত সেনাপ্রধান আটক

Spread the love

বাঙালিনিউজ, বিশ্বডেস্ক

গতকাল ২৬ জুন ২০২৪ রোজ বুধবার বিকেলে, লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায় সেনাবাহিনীর একটি অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আটক করা হয়েছে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেওয়া সেনাপ্রধান জেনারেল হুয়ান হোসে জুনিগাকে। তাঁকে বরখাস্ত করে নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ করা হয়েছে। সেনা সদস্যরাও ব্যারাকে ফিরে গেছেন।

অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চলাকালেই জেনারেল জুয়ানকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে বরখাস্ত করেন বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট লুইস আর্চি। আটকের পর সদ্য সাবেক সেনাপ্রধানকে কোথায় নেওয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি।

বলিভিয়া সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশটিতে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

জানা গেছে, বলিভিয়ার রাজধানী লাপাজের ঐতিহাসিক সেন্ট্রাল প্লাজা মুরিলো চত্বরে গতকাল ২৬ জুন বুধবার জড়ো হতে থাকেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ট্যাংকসহ অন্যান্য সাঁজোয়া যানও ছিল। এই চত্বরে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্টের বাসভবন ও কংগ্রেস ভবন রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, অভিযানের একপর্যায়ে একটি ট্যাংক প্রেসিডেন্টের বাসভবনের ধাতব ফটক ভেঙে ফেলার চেষ্টা চালায়।

সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখন প্লাজা মুরিলো চত্বরে ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে জড়ো হন, তখন নিজের বাসভবনেই ছিলেন প্রেসিডেন্ট লুইস আর্চি। সেনাবাহিনীর অভিযান চলাকালে টেলিভিশনে দেওয়া এক বার্তায় প্রেসিডেন্ট আর্চি জনগণকে গণতন্ত্রের পক্ষে থেকে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসও জাতির প্রতি একই আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘একটি অভ্যুত্থান ঘটছে।’

প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে প্রেসিডেন্ট আর্চি এক বার্তায় বলেন, ‘দেশ আজ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মুখোমুখি। আবারও বলিভিয়ার গণতন্ত্রকে কাটছাঁট করার স্বার্থের মুখে পড়েছে আমাদের দেশ।’

এ সময় জনগণের সহায়তা চান প্রেসিডেন্ট লুইস আর্চি। তিনি বলেন, ‘আমি বলিভিয়ার জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আজ সংঘটিত হওয়ার জন্য। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের পক্ষে থেকে অভ্যুত্থানচেষ্টায় জড়িতদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন।’

সেনা জওয়ানরা তার প্রাসাদে আসার পর প্রেসিডেন্ট আর্চি সামাজিক মাধ্যমে বলেন, ”বলিভিয়ার সেনার কয়েকটি ইউনিট বেআইনিভাবে জড়ো হয়েছে। গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে।”

স্থানীয় টিভি চ্যানেলের ফুটেজে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের ভিতরে প্রেসিডেন্ট আর্চির সঙ্গে সেনাপ্রধান জুনিগার কথা বলছেন। প্রেসিডেন্ট আর্চি সেনাপ্রধান ও সেনা সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, ”আমি আপনাদের ক্যাপ্টেন, আমি নির্দেশ দিচ্ছি, আপনারা ফিরে যান। আমি কোনো অবাধ্যতা বরদাস্ত করব না।”

এর কয়েক ঘণ্টা পর প্লাজা মুরিলো চত্বর থেকে সেনাসদস্য ও ট্যাংকগুলোকে সরিয়ে নিতে দেখা যায়। আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযানের সময় প্রেসিডেন্টের বাসভবনের বাইরে অবস্থান করছিলেন জেনারেল হুয়ান। তাঁকে ঘিরে ছিল সেনাসদস্যসহ আটটি ট্যাংক। এ সময় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তিনি।

সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সেনাপ্রধান জুনিগার বলেন, সশস্ত্র বাহিনী দেশে গণতন্ত্র পুনর্গঠন করতে চায়, সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হাতে গোনা সেই একই ৪০-৫০ জনকে দেশ পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না।

জুনিগার টেলিভিশন ভাষণে বলেন, তার আশা ছিল সরকারে পরিবর্তন হবে। তিনি সাবেক অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট-সহ রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন।

সেনাবাহিনীর এই অভিযানের পরপরই জেনারেল জুনিগার হুয়ানকে তাঁর পদ থেকে বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট লুইস আর্চি। নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় হোসে উইলসন সানচেজকে। তিনি সেনাসদস্যদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ আহ্বান জানান প্রেসিডেন্টও। এর কিছুক্ষণ পরই সেনাসদস্য ও ট্যাংকগুলোকে প্লাজা মুরিলো চত্বর থেকে সরিয়ে নিতে দেখা যায়।

ফলে এই সেনা অভ্যুত্থান দার্ঘস্থায়ী হয়নি। ২৬ জুন বুধবার বেলা চারটে নাগাদ তারা প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে ঢোকে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেনা প্রেসিডেন্টের বাসভবন-সহ সরকারি এলাকা থেকে সরে যায়। প্রেসিডেন্টের নির্দেশ ও অন্য সরকারি কর্মকর্তারা এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করার পর তারা সরে যায়।

সেনা যখন ফিরে যাচ্ছে, তখন আরসের হাজার হাজার সমর্থক বলিভিয়ার পতাকা নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে, হুয়ান হসে জুনিগারকে সেনাপ্রধান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে—এমন জল্পনা ২৫ জুন মঙ্গলবার থেকে চলছিল। আগের দিন ২৪ জুন সোমবার টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে হুঁশিয়ারি দিয়ে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট মোরালেস যদি আবার ২০২৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে।

প্রেসিডেন্ট আর্চির পাশে মোরালেস

সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালস প্রেসিডেন্ট আর্চির পাশে দাঁড়িয়েছেন। মোরালেস সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে বলেছেন, তিনি তার সমর্থকদের গণতন্ত্রের পক্ষে থাকতে বলছেন। সেনাকে কিছুতেই গণতন্ত্র ধ্বংস করতে দেয়া হবে না এবং মানুষকে ভয় দেখাতে দেয়া হবে না।

স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বলিভিয়া অন্তত ২০০ সেনা অভ্যুত্থান ও বিদ্রোহ দেখেছে। ২০১৯ সালে মোরালসকে যখন ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়, তখনো তাকে সরানোর পিছনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল।

মোরালেস নিয়ম ভেঙে চতুর্থবার প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী জানিয়ে দেয়, তারা মোরালেসকে তাঁর অফিসে নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। এরপর মোরালেস পদত্যাগ করেন এবং তার সমর্থকরা অভিযোগ করেন, সেটাও ছিল সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা।

বলিভিয়ার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা প্রথম প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস। বামপন্থী এই নেতা দেশটিতে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। সংবিধান সংশোধন করে ২০১৯ সালে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার চেষ্টার পর, তাঁর সেই জনপ্রিয়তায় ধস নামে। তিনি ওই নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন। তবে দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন। দেশ ছেড়ে পালাতেও হয়েছিল তাঁকে। পরে লুইস আর্চি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দেশে ফেরেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস।

বিশ্ববাসীর নিন্দা

এদিকে, গতকাল ২৬ জুন বুধবার বলিভিয়ায় সেনাবাহিনীর অভিযানের পর এর নিন্দা জানিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা লিখেছেন, ‘আমি গণতন্ত্র ভালোবাসি, আর চাই পুরো লাতিন আমেরিকা গণতন্ত্র টিকে থাকুক। বলিভিয়ায় যে কোনো ধরনের অভ্যুত্থানের নিন্দা জানাচ্ছি আমরা।’

এক্সে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলিভিয়ার সব পক্ষকে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি সম্মান জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক মুখপাত্র বলেছেন, বলিভিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে মার্কিন প্রশাসন। একই সঙ্গে দেশটিতে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। খবর: রয়টার্স, এএফপি, এপি, আল জাজিরা, ডয়েচ ভেলে।