ভারতে লোকসভা নির্বাচন-২০২৪
দ্যুতিময় বুলবুল
ভারতে এবার ২০২৪ সালের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে, মোদী ম্যাজিকে কাজ হলো না। ধর্মের ধ্বজাও উড়লো না। এমনকি, তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে মোদীর ৪৫ ঘণ্টার ধ্যানও রক্ষা করতে পারলো না বিজেপিকে! বুথ ফেরত জনমত জরিপ তো মিলল-ই না। ‘৪০০’ কিংবা ’৩৭০‘ পার করা দূরে থাক, দুই দফায় টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে বিজেপি।
সরকার গড়ার জন্য যেখানে লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৭২টি আসন দরকার, সেখানে বিজেপি পেয়েছে ২৪০টি। ম্যাজিক সংখ্যার চেয়ে ৩২টি কম। মূলত, ৫৪৫ আসনের (২টি মনোনীত আসন-সহ) লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৭৩টি আসন।
মাত্র সাড়ে ১১ মাস আগে গড়া বিরোধী জোট (যাকে প্রচারপর্বের আগাগোড়া কটাক্ষ করে এসেছেন মোদী-সহ বিজেপি নেতারা) আটকে দিলো ‘পদ্মে’র নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পথ।
অন্যদিকে, এবারের ভোটে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পেয়েছে ৯৯টি আসন। অন্য দলগুলোর মধ্যে সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ৩৭টি, তৃণমূল কংগ্রেস ২৯টি, ডিএমকে ২২টি, তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) ১৬টি, জনতা দল (জেডি-ইউ) ১২টি, শিবসেনা (উদ্ভব) ৯টি, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপিএসপি) ৮টি, শিবসেনা (এসএইচএস) ৭টি ও লোক জনশক্তি পার্টি (রাম বিলাস) ৫টি আসন পেয়েছে।
এছাড়া সিপিআই (এম) ৪টি, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট) ৪টি, ওয়াইএসআরসিপি ৪টি ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) ৪টি আসন পেয়েছে। আম আদমি পার্টি, ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) ও ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ (আইইউএমএল) ৩টি করে আসন পেয়েছে।
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই), কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট–লেনিনিস্ট) (লিবারেশন)–সিপিআই (এমএল) (এল), জনতা দল-জেডি (এস), জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স (জেকেএন), রাষ্ট্রীয় লোক দল (আরএলডি), জনসেনা পার্টি (জেএনপি) ও ভিসিকে ২টি করে আসনে জয় পেয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি দল ১টি করে আসন পেয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন ৭ জন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’ জানাচ্ছে, ঘোষিত ফল অনুযায়ী বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স–এনডিএ জোটের মোট আসন সংখ্যা ২৯৬টি। আর অন্যদিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের মোট আসনসংখ্যা ২৩১টি। অন্যরা ১৬টি আসন পেয়েছে। ফলে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইান্ডয়া জোটের চেয়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিপি জোট ৬৫টি আসন বেশি পেয়েছে। মূলত, বিজেপি এবং কংগ্রেস ছাড়া অন্যরা আসন পেয়েছে ২০৪টি।
এর আগে ২০১৯ সালের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে, বিজেপি ৩০৩টি আসন পেয়েছিল। সেবার বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ পেয়েছিল ৩৫২টি আসন। আর কংগ্রেস পেয়েছিল ৫২টি আসন এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ইউপিএ জোট পেয়েছিল ৯৪টি আসন।
এবারের ভোটের ফল বলছে, নরেন্দ্র মোদী জোটের সমর্থনে সরকার গঠন করতে পারলেও, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি মানুষের ঢালাও সমর্থন কমেছে। গত দু‘বার বিজেপির পক্ষে কাজ করেছিল মোদী ম্যাজিক এবং হিন্দু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী হাওয়া! এবার সেই ম্যাজিক অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। তাই এক ধাক্কায় বিজেপির আসন ৩০৩ থেকে ২৪০ এ নেমে এসেছে।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভোট উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। নিজের বারাণসী কেন্দ্র থেকে মোদী জয় পেলেও, গতবারের তুলনায় তাঁর জয়ের ব্যবধান কমেছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। এক পর্যায়ে পিছিয়েও পড়েছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ ভোটে জিতেছেন মোদী।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের তকমা হারিয়ে বিজেপিকে এখন সরকার গঠনের জন্য এনডিএ জোট শরিকদের সমর্থন নিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে সরকার চালাতে শরিক দলগুলোর ওপরে অনেকটাই নির্ভর করতে হবে বিজেপিকে। সে ক্ষেত্রে এনডিএ শরীকরা বিজেপির ওপর নানাভাবে চাপ বৃদ্ধি করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরিকদের মধ্যে প্রধান দু’টি দল অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি এবং বিহারে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জনতা দল-ইউনাইটেড (জেডি–ইউ) পার্টি এখন বিজেপির ভাগ্য নির্ধারক। অতীতে এই দুই নেতা একাধিক বার মোদী সরকারের এনডিএ জোট থেকে বেরিয়ে গেছেন। আবার ফিরেও এসেছেন। ফলে মোদী তৃতীয় দফায় চন্দ্রবাবু ও নীতীশকে নিয়ে সরকার গঠন করলেও, স্বস্তিতে থাকতে পারবেন কিনা-তাতে সন্দেহ রয়েছে।
এছাড়াও এনডিএ শরীক মহারাষ্ট্রের শিবসেনার সিন্ধে গোষ্ঠী, বিহারে লোক জনশক্তি পার্টি এবং উত্তর প্রদেশের রাষ্ট্রীয় লোক দলের সমর্থন লাগবে। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নতুন ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে বিজেপিকে। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায়, এ ধরনের সমস্যায় তারা গত দু’বার পড়েনি। সামনে ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
এবার ২০২৪ সালে ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে ১০ বছর পর, আবার একদলীয় শাসনের অবসান ঘটতে চলেছে। সেই সঙ্গে এই অষ্টাদশ লোকসভায় আনুষ্ঠানিক ভাবে ফিরতে চলেছে বিরোধী দলনেতার পদও।
২০১৪ ও ২০১৯ সালে মোদী ঝড়ে আসমুদ্রহিমাচল লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবল হাওয়ায় ভেসেছিল ভারতের অধিকাংশ রাজ্য। এবারের ভোটে সেই মোদী ঝড়ের তীব্রতা ছিল না। এমনকি, হিন্দি–বলয়েও রাম মন্দিরের হিন্দুত্ববাদী হাওয়া লাগে নি। তারপরও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতেই ভারতের শাসন ভার থাকছে।
২০১৪ এবং ২০১৯-এর মতো এবার সংসদের নিম্নকক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায়, পদ্মশিবির হতাশ। কারণ, জোটসঙ্গীদের মধ্যে বেশি আসন পাওয়া দলগুলো বিরোধী শিবিরে ভিড়লে চিত্র ভিন্ন হতে পারে। বিশেষ করে চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতীশ বিগড়ে গেলে বিজেপি বিপদে পড়বে। এই দুই নেতা অতীতে একাধিক বার এনডিএ ত্যাগ করেছেন। আবার প্রত্যাবর্তনও করেছেন।
শোনা যাচ্ছে, কংগ্রেস জোট নাইডু ও নীতীশ সহ এনডিএ জোটের অনেকের সঙ্গে কথা বলছে, বিজেপিকে ছেড়ে তাদের জোটে যোগ দেওয়ার জন্য।
তবে এটা স্মরণযোগ্য যে, ভারতের ইতিহাসে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর পর মোদীই হতে চলেছেন দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি পর পর টানা তিনবার লোকসভা নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন। তবে জওহরলাল নেহেরুর মতো পর পর তিনবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার চেয়ারে বসার রেকর্ড গড়তে পারেন নি মোদী।
অন্যদিকে, এই লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করতে না পেরে টানা তিনবার বিরোধী দলের আসনে বসতে যাচ্ছে কংগ্রেস। তবে গত দুইবারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ আসন পেয়ে কংগ্রেস লোকসভায় এবং জাতীয় রাজনীতিতে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী দলনেতার পদের জন্য লোকসভায় ৫৫টি আসনে জেতা প্রয়োজন। কিন্তু ২০১৪ সালের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে ৪৪টি আসন এবং ২০১৯ সালের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে ৫২টি আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। ফলে সংসদীয় বিধি অনুযায়ী, গত দুই লোকসভায় বিরোধীদলের মর্যাদাও পায় নি তারা।
তবে এবার বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেস মুখোমুখি লড়াই করেছে। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট গতবার যেখানে পেয়েছিল মাত্র ৯৪ আসন, সেখানে এবার বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ পেয়েছে ২৩১ আসন। এনডিএ জোটের চেয়ে ৬৫টি আসন কম হলেও, বিরোধী জোট আগের চেয়ে অনেক ভালো করেছে।
ভোটের প্রচারে বিরোধী জোট ইন্ডিয়া তীব্র বেকারত্ব, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও সংবিধান–গণতন্ত্র রক্ষার ওপর জোর দিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, সেই প্রচার কাজে লেগেছে। এনডিএ জোটের ধর্মের ব্রক্ষ্মাস্ত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। ফলে এনডিএ এবং ইন্ডিয়া’র মধ্যে জোর লড়াই হয়েছে।
ভারতে এ বারের ২০২৪ সালের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন গত ১৯ এপ্রিল শুরু হয়েছিল। সাত দফার ভোট শেষ হয় গত ১ জুন। গতকাল ৪ জুন মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে ভোটগণনা শুরু হয়। প্রথমে পোস্টাল ব্যালট, তারপর ‘ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন’ তথা ইভিএম-এ পড়া ভোটের গণনা শুরু হয়। রাতে নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে।
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।