বাঙালিনিউজ অনলাইনডেস্ক
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্য সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী চাইলেই রাতের বেলা নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে পারে না, এর কারণ হলো তাদের কিছুক্ষণ পরপরই শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য বাতাস লাগে। এমনকি পানির পৃষ্ঠে ভেসে ঘুমানোর সুযোগও নেই এদের, কারণ এতে শিকারির সম্ভাব্য আক্রমণ ও তাদের শারীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
তাহলে কীভাবে এইসব প্রাণীরা ঘুমায়?
এসব প্রাণীর ঘুমানোর একটি জবাব হতে পারে– সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীরা মানুষের মতো মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ অংশ একবারে বন্ধ করে ঘুমায় না। বরং ঘুমানোর সময় তারা মস্তিষ্কের অর্ধেক অংশ বন্ধ করে রাখে, যা ‘ইউনিহেমিস্ফিয়ারিক স্লিপ’ নামে পরিচিত।
‘ইউনিহেমিস্ফিয়ারিক স্লিপ’এমন এক উপায়, যেখানে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীরা বিশেষ করে ডলফিন উন্মুক্ত পানিতে কিছুটা সময় বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকে।
যুক্তরাজ্যের ‘ইউনিভার্সিটি অফ সেইন্ট অ্যান্ড্রুজ’-এর জীববিজ্ঞানী প্যাট্রিক মিলার বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘লাইভ সায়েন্স’কে বলেছেন, এমন ঘুম সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য সত্যিই অনেক বেশি মূল্যবান। কারণ অর্ধেক ঘুমানোর ফলে তাদের মস্তিষ্কের অন্য অংশের কার্যকলাপ সক্রিয় থাকে।”
এ নিয়ে গবেষণার জন্য সবচেয়ে উপযোগী হল ডলফিন। কারণ, ডলফিন এই ভঙ্গি বা শৈলীতেই ঘুমিয়ে থাকে। ডলফিনের মস্তিষ্ক স্ক্যান করলে দেখা যায়, যখন ডলফিনের মস্তিষ্কের একটি অংশ গভীর ঘুমে থাকে, তখন অন্য অংশটি সতর্ক থাকে। আর এটাই প্রাণীদের আক্ষরিক অর্থে এক চোখ খোলা রেখে ঘুমাতে সাহায্য করে।
এ ধরনের ঘুমের শৈলী ‘সিটাসিয়ান’ প্রজাতির প্রাণীর (স্তন্যপায়ী প্রাণীদের যে দলটিতে ডলফিন, তিমি ও পোর্পোইজ রয়েছে) কাছে খুবই সাধারণ বিষয়।
সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মতো পাখির অনেক প্রজাতিও ‘ইউনিহেমিস্ফিয়ারিক স্লিপ’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ঘুমানোর জন্য পরিচিত, যার মাধ্যমে প্রায়ই পাখিরা ওড়ার সময় ঘুমিয়ে থাকে।
তবে গবেষক মিলার বলছেন, পাখি ও ডলফিনের এমন অর্ধেক মস্তিষ্কের ঘুমের উদ্দেশ্য ভিন্ন। উদাহরণ হিসেব, পাখির ঝাঁকে অনেক সময় তাদের দলের বাইরের পাখিও ঢুকে পড়ে, যারা শিকারীদের উপর নজর রাখতে নিজেদের চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখে।
এদিকে, ডলফিনের বেলায় বিষয়টি পুরো উল্টো। এরা ঘুমানোর সময় চোখ খোলা রাখে, যার ফলে এদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে।
তবে সব ধরনের সিটাসিয়ান ‘ইউনিহেমিস্ফিয়ারিক স্লিপ’ ব্যবহার করে ঘুমায়, বিষয়টি এমন নয়। কোনো কোনো প্রাণী আবার ‘বিহেমিস্ফিয়ারিক স্লিপ’ নামের পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে, যেখানে মস্তিষ্কের উভয় দিকই ঘুমিয়ে পড়ে। ঠিক যেমন মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী ঘুমায়।
মিলার বলেন, “পানির নীচে স্পার্ম তিমি বা অ্যাম্বার তিমি, নীল তিমি বা হাম্পব্যাক তিমির মতো প্রাণীদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পরিমাপ করা সত্যিই জটিল বিষয়।।”
“এক্ষেত্রে, আমাদের কাছে এমন প্রাণীদের ঘুম পরিমাপের সেরা সূচক হতে পারে এদের আচরণ।”
গবেষকরা প্রাণীদের আচরণ পরীক্ষার জন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দেহে একটি ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে দেন। মিলারের নেতৃত্বে ২০০৮ সালের এক গবেষণায় স্পার্ম তিমির দেহের সঙ্গে ‘সাকশন ট্যাগ’ বা শোষক যুক্ত করা হয়েছিল।
এতে দেখা যায়, তিমিরা ছোট খাটো সময়ের জন্য উন্মুক্ত সমুদ্রে ঘুমায়। এজন্য তিমিরা পানির অগভীরে ডুব দেওয়ায় এদের সাঁতারের গতি থেমে যায় ও অলসভাবে এরা ওপরের দিকে উঠতে শুরু করে। এদের ঊর্ধ্বমুখী যাওয়ার সম্ভাব্য কারণ, তিমিদের মাথায় থাকা ‘স্পার্মাসিটি’ নামের তেল।
ঘুমানোর সময় তিমিরা সমুদ্রের ঠিক নীচের পৃষ্ঠে এদের নাক উঁচু করে রাখে। আর এই সময় তাদের কোনো ধরনের সাড়াশব্দও পাওয়া যায় না, যার মানে তারা গভীর ঘুমে মগ্ন আছে।
যাই হোক, প্রাণীরা অক্সিজেনের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে ফিরে আসার আগে পানির নিচে প্রায় ২০ মিনিট পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে পারে। একবার তিমি শ্বাস নেওয়ার পরে এরা আবারও বিশ্রামের জন্য পানির নীচে নেমে আসে। এভাবে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত তিমিরা এই আচরণ চালিয়ে যেতে পারে।
প্রথমবারের মতো সমুদ্রের নিচে ঘুমিয়ে থাকা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ‘ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান দিয়েগো’-এর ‘স্ক্রিপস ইনস্টিটিউশন অফ ওশেনোগ্রাফি’ বিভাগের পোস্টডক্টরাল গবেষক জেসিকা কেন্ডাল-বারের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের এক গবেষণায়।
গবেষণায় কেন্ডাল-বার ও তার সহকর্মীরা দেখতে পান, সিলমাছ প্রায় এক হাজার ফুট (প্রায় ৩০০ মিটার) গভীরে ডুব দেয়, যেখানে তাদের মস্তিষ্কের কাজ করার গতি কমে যায় ও দ্রুত এরা ঘুমিয়ে পড়ে, যা ‘র্যাপিড আই মুভমেন্ট (আরইএম)’ নামে পরিচিত। ঘুমানোর সময় সিলমাছের শরীর উল্টে গিয়ে ক্রমশ একটি ধীর গতির বৃত্তের মতো ঘুরতে থাকে।
“সমুদ্রের নিচে ঘুমের সময় সিলমাছ পুরোপুরি উল্টে যায়। গবেষকদের ধারণা, মানুষের মতো সিলমাছেও ঘুমের সময় প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে,” একটি ইউটিউব ভিডিওতে ওই গবেষণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন কেন্ডাল-বার।
সম্ভবত শিকারের হাত থেকে বাচঁতে ‘এলিফ্যান্ট সিল’ (হাতির মতো দেখতে সিল মাছ) সমুদ্রে মোট ঘুমের সময়কে দৈনিক প্রায় দুই ঘণ্টার মধ্যে আটকে ফেলেছে, “যেখানে সব ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে কম ঘুমের রেকর্ডে তাদের চেয়ে কেবল এগিয়ে আছে আফ্রিকান হাতি,” লিখেছেন গবেষকরা।
সূত্র: বিডি নিউজ ২৪