দ্যুতিময় বুলবুল
তৃতীয় পর্ব
মূলত সর্বজনীনভাবে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ৮মে, ১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ,ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরের শান্তিনিকেতনে। এটাই ছিল কবির শান্তিনিকেতনে প্রথম জন্মদিন উদযাপন। এর আগে, ১৮৮৭ সাল থেকে (১২৯৪ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ) ২২ বছর ধরে, পারিবারিকভাবে ঘরোয়া পরিবেশে কবির জন্মদিন পালিত হতো।
রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, কালক্রমে যা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ ধারণ করে। এই বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনের অধ্যাপক অমর্ত্য মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, শান্তিনিকেতনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ৮মে, ১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ সেদিন ৪৯ পেরিয়ে ৫০ বছর বয়সে পদার্পণ করেন। দিনটা ছিল রবিবার।
৫০তম জন্মদিনকে কেন্দ্র করে এই ব্যাপক আবেগময় উৎসব আয়োজনের কথা কবিকে আগে থেকে জানানো হয়নি। ক’দিন পর পুরীতে যাবেন কবি, তাই ১২ই বৈশাখ তিনি শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যান। কিন্তু ১৮ই বৈশাখ শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন তিনি। তখন দেখলেন, আশ্রম জুড়ে তাঁর জন্মোৎসবের সাজ সাজ রব।
সেই বছরই প্রথম বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় শান্তিনিকেতনে আশ্রমিক ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেছিলেন। এই উৎসবের নাম দিয়েছিলেন তাঁরা “আত্মীয়দের উৎসব”। রবীন্দ্রনাথের এই প্রথম আশ্রমিক জন্মদিন উদযাপনে সাড়া পড়ে যায় দেশ-বিদেশ, সবখানে। সেই বছর ১৯১০ সাল থেকেই, কবির আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজনদের বাইরে, তাঁর জন্মদিনের উৎসব শুরু হয়। তার আগে, ৩১শে চৈত্র সন্ধ্যায় সর্বশেষ মন্দিরের পর, ১লা বৈশাখ কবিকণ্ঠের মাধ্যমে নববর্ষবরণ উৎসবের সূচনা করা হয়েছিল।
৫০তম জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথকে আগে থেকে না জানিয়ে মহাসমারোহে জন্মদিন পালনে আশ্রমবাসীদের আয়োজন দেখে কবি দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। আশ্রমিকদের এই আয়োজনে কবি এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন যে, আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রফুল্লকুমার সরকারের স্ত্রী নির্ঝরিণী সরকারকে চিঠি লিখে তাঁর সেই খুশির কথা জানিয়েছিলেন। তারপর থেকে প্রতিবছর শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উৎসবের আমেজে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে পালন করা হয়ে থাকে।
জন্মজয়ন্তী উৎসবকে কেন্দ্র করে উদ্যোক্তাদের মধ্যে যে উল্লাস-উচ্ছ্বাস ও আনন্দ-কোলাহল এবং আন্তরিকতা ও একাত্মতার পরিচয় রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন, সেই আনন্দ ও অনুভূতির কথা জন্মদিনের ভাষণে তিনি তীব্র আবেগজড়িত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন। কবি শান্তিনিকেতনে সংবর্ধনা সভায় বলেছিলেন, “বাপ মায়ের ঘরে যখন জন্মেছিলুম তখন অকস্মাৎ কত নূতন লোক চিরদিনের মতো আপনার হয়ে গিয়েছিলেন, আজ ঘরের বাইরে আর একটি ঘরে আমার জীবন যে নবজন্ম লাভ করেছে, এখানেও একত্র কতো লোকের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ বেঁধে গেছে। সেই জন্যই আজকের এই আনন্দ।”
১৯১০ খ্রিস্টাব্দে তথা ১৩১৭ বঙ্গাব্দে বোলপুরে শান্তিনিকেতনে এই সংবর্ধনা-ভাষণে কবি তাঁর জন্মদিনের কথা উল্লেখ করে আরো বলেন, “কতো পঁচিশে বৈশাখ চলে গিয়েছে, তারা অন্য তারিখের চেয়ে কিছুমাত্র বড়ো করে আমার কাছে প্রকাশ করেনি।”
আশ্রমবাসী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এই সম্মিলিত আয়োজনে মুগ্ধ ও আবেগপ্রবণ কবি সংবর্ধনা সভায় আয়োজকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “আমার এই পঞ্চাশ বৎসর বয়সেও আমাকে তোমরা নূতন করে পেয়েছ, আমার সঙ্গে তোমাদের সম্বন্ধের মধ্যে জরাজীর্ণতার লেশমাত্র লক্ষণ নেই। তাই আজ সকালে তোমাদের আনন্দ-উৎসবের মাঝখানে বসে আমার এই নবজন্মের নবীনতা অন্তরে বাহিরে উপলব্ধি করছি৷”
রবীন্দ্রনাথ লিখিত ভাষণ পাঠ না করেই তাৎক্ষণিকভাবে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেই বক্তব্য অনুলিখন করা হয়েছিল। ‘জন্মোৎসব’ শিরোনামে অনুলিখিত বক্তব্যটি ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সেদিনই বিশিষ্ট বাঙালি কবি, সনেট রচয়িতা ও সমাজসেবিকা প্রিয়ম্বদা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, “আজ প্রাতে আমার জন্মদিন উৎসব হয়ে গেল। আমার যে একটা জন্মদিন আছে, সে কথা ভুলে গিয়েছিলুম। … আজ মনে হলো আর এক জন্ম লাভ করেছি–এখন যারা আমার কাছে এসেছে, আমাকে কাছে পেয়েছে, আমি তাদের ছেলে। তারাই আনন্দ করে আজ সকালে আমাকে নিয়ে উৎসব করেছে–এই আমার আশ্রমের জীবন, এই আমার মঙ্গললোকে নূতন জন্ম লাভ–ঈশ্বর এই জন্মকে সার্থক করুন, প্রার্থনা করি।”
১৯১০ সালের এই ৫০তম জন্মোৎসবের সন্ধ্যায় আশ্রমের ছাত্র-শিক্ষকরা মিলিতভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। এই নাট্যাভিনয়ের স্মৃতি তুলে ধরেছেন সুধীরঞ্জন রায় তাঁর ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ বইটিতে। সুধীরঞ্জন লিখেছেন, “জগদানন্দবাবু সেজেছিলেন রাজজামাতা রামচন্দ্র। দিনুবাবু তখন ক’দিনের জন্যে বাইরে গিয়েছিলেন বলে তাঁর কথা ভাবা হয়নি। কিন্তু অভিনয়ের দিন দুই আগে হঠাৎ তিনি ফিরে এলেন, তখন তো পদগুলি সবই বিলি হয়ে গেছে। কী উপায়—ভেবেচিন্তে তাঁকে করা হলো রামচন্দ্রের সভা-গায়ক।…
নাটকের নির্দেশ ছিল যে সভার ওস্তাদ যখন গান গাইবেন, তখন রাজা রামচন্দ্র বিজ্ঞ সমঝদারের মতো মাঝে মাঝে ‘বাহবা ওস্তাদজী’ বলবেন—আর ভুল জায়গায় তাল দেবেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জগদানন্দবাবুর তালজ্ঞান যথেষ্ট প্রখর ছিল, কাজেই বেতালে তাল দেওয়া তাঁর পক্ষে সহজ হচ্ছিল না৷” সেসব দেখে ‘দর্শকরা হেসে ফেটে’ পড়েছিলেন।
শান্তিনিকেতনে সেদিনের জন্মোৎসবের কথা উল্লেখ করেছেন, “রবীন্দ্রজীবনী” (চার খণ্ড) লেখক ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রকাশক (চার খণ্ড) প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, “আশ্রমের নিরালার মধ্যে যে আনন্দ উৎসব সম্পন্ন হইল, তাহা অত্যন্ত আন্তরিক নিতান্ত আত্মীয়দের উৎসব।” রবীন্দ্র গবেষক প্রভাতকুমার এই ১৯১০ সালেই শান্তিকেতনে ব্রহ্মাচর্যাশ্রমের শিক্ষক নিযুক্ত হন। ছয় বছরের অধিক সময় তিনি শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ৮মে, ১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ, শান্তিনিকেতনে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের পর থেকে, আশ্রমিকেরা নিয়মিত কবির জন্মদিন উদযাপন করে এসেছেন। পরবর্তীকালে কবি বিশ্বব্যাপী তাঁর গুণগ্রাহীদের রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের আবেদন নিবেদন ফেরাতে পারেননি। ভক্তদের দাবি মানতে বাধ্য হন কবি। ফলে এরপর থেকে ধীরে ধীরে দিনটি বাঙালির জাতীয় চেতনা ও প্রেরণার অন্যতম প্রতীকে পরিণত হয়। একইসঙ্গে বাঙালির শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রকাশে সবচেয়ে প্রিয় ও প্রাসঙ্গিক মাধ্যম এবং সংগ্রাম সাহস প্রতিবাদ প্রতিরোধ ও আনন্দ বিনোদন এবং আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণের আন্তর্জাতিক উৎসবে পরিণত হয় রবীন্দ্রজয়ন্তী। (চলবে)
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।