ভারতে লোকসভা নির্বাচন ২০২৪
দ্যুতিময় বুলবুল
এবার ২০২৪ সালের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের আগে-ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, “আব কি বার, ৪০০ পার”, মানে এবার চার শতাধিক আসনে জিতবে তাঁর দল, ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি। গতবার ২০১৯ সালের সপ্তদশ লোকসভায় বিজেপির আসন ছিল ৩০৩টি। নির্বাচনের আগে মোদী ও তাঁর প্রধান সেনাপতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এবার বিজেপির আসন সংখ্যা ৩০৩ থেকে বেড়ে ৩৭০ পেরিয়ে যাবে।
কিন্তু গত ৪ জুন মঙ্গলবার, ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, চার শতাধিক আসন কিংবা ৩৭০ আসন পার করা তো দূরের কথা, ৫৪৩ আসনের লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ২৭২টি আসনও পায়নি বিজেপি। তারা গতবারের ৩০৩টি আসন থেকে ৬৩টি হারিয়ে, এবার পেয়েছে ২৪০টি আসন। ফলে নরেন্দ্র মোদীকে গত ৯ জুন সরকার গঠন করতে আরো অন্তত ৩২টি আসনের জন্য এনডিএ জোটের শরিকদের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে। যদিও এনডিএ গতবারের ৩৫২টি আসন থেকে এবার ৫৯টি আসন হারিয়ে, ২৯৩ আসনে নেমে এসেছে।
তবে জোট সঙ্গীদের সমর্থন পেলেও, এই নতুন মোদী সরকারের ভবিষ্যত অনিশ্চিত বলে অনেকে মনে করছেন। তারা বলছেন, মোদীর বিজেপি আবার ক্ষমতায় এসেছে সত্য। কিন্তু তারপরও তাদের এবারের জয়কে ‘হারের চেয়েও বেশি গ্লানিময়’ মনে হচ্ছে।
বিজেপির এবারের নির্বাচনের ফলাফলে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও দৃষ্টান্তমূলক সুস্পষ্ট বিপর্যয় হলো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রাপ্ত ভোটের বিস্ময়কর হ্রাস। যে ব্যবধানে মোদী উত্তরপ্রদেশের বারাণসী আসনটি জিতেছেন, তা দলের ও তাঁর নিজের অস্বস্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বারাণসী থেকে এবার মোদীর জয়ের ব্যবধান ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার ৫১৩ ভোট। শতাংশের হিসাবে যা ১৩.৪৯ শতাংশ। গত দু’বারের নির্বাচনের চেয়ে এই ব্যবধান বিশাল। অর্থাৎ, আগের চেয়ে অনেক কম ভোট পেয়েছেন মোদী। এবার গতবারের চেয়ে তাঁর প্রায় তিন লাখ ভোট ব্যবধান কমেছে।
২০১৪ সালে প্রথমবার বারাণসী থেকে ৫.৮১ লাখ ভোট পেয়েছিলেন মোদী। সেবার আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে ৩.৭ লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে সেই বারাণসীতেই দ্বিতীয়বার ভোটে মোদীর ব্যবধান আরও বৃদ্ধি পায়। তিনি দ্বিতীয়বার ৬.৭৪ লাখ ভোট পেয়েছিলেন। ব্যবধান ছিল ৪.৭৯ লাখ। সেবার তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সমাজবাদী পার্টির শালিনী যাদব।
এবার মোদীর ভোটের সংখ্যা উর্ধ্বমুখী নয়, নিম্নমুখী হয়েছে। বারাণসীতে মোদীর তৃতীয় দফা ভোটে, এবার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের অজয় রাই শুধু মোদীর সঙ্গে ভোটের ব্যবধানই কমাননি, গণনা শুরুর পর প্রাথমিক ‘ট্রেন্ডে’ একবার তাঁকে পেছনেও ফেলেছিলেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এই লোকসভা নির্বাচনে বারাণসী থেকে মোদীর বিপরীতে দাঁড়ানো কংগ্রেস প্রার্থী অজয় রাই পেয়েছেন ৪ লাখ ৬০ হাজার ৪৫৭ ভোট। আর নরেন্দ্র মোদী পেয়েছেন ৬ লাখ ১২ হাজার ৯৭০টি ভোট। ফলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কংগ্রেস প্রার্থী অজয়কে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫১৩ ভোটে হারিয়েছেন। এটাই মোদীর সর্বনিম্ন জয়-ব্যবধান।
তবে গতবারের প্রার্থী শালিনীর চেয়ে মোদীর বিরুদ্ধে ২ লাখ ৮৪ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী অজয়।
শুধু তাই নয়, মোদী এবার যে ভোট পেয়েছেন-তা ভারতের সব প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কম ভোটের ব্যবধানে জেতার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এর আগে কেবল একজন প্রধানমন্ত্রী তাঁর চেয়ে কম ভোটে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন। তিনি হলেন চন্দ্র শেখর, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল দেড় লাখেরও কম। শতাংশের বিচারে তা মাত্র ১২.৭৮ শতাংশ।
ভোট ব্যবধানের তালিকায় এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে উপরে রয়েছেন নেহেরু-গান্ধী পরিবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। ১৯৮৪ সালে তিনি ৭২.১৮ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন। যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮৪ এবং ১৯৮৯ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে, সর্বাধিক ভোটের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দু’বার রেকর্ড বা নজির সৃষ্টি করেছেন।
সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রধানমন্ত্রীদের এই তালিকায় তিন নম্বরে আছেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৯ সালে তাঁর জয়ের ব্যবধান শতাংশের বিচারে ৪৫.২২ শতাংশ। আর এবার নরেন্দ্র মোদীর চেয়ে তাঁর দলের ১১২ জন এবং অন্য দলের প্রার্থী ১১২ জন সহ মোট ২২৪ জন প্রার্থী বেশি ব্যবধানে জিতেছেন।
গত ১০ বছরের দাপুটে রাজনীতি ও ভারত শাসনের পরও, ‘মোদী ম্যাজিক’ ব্যর্থ হলো-এবার ২০২৪ সালের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে। ফিকে হলো বিজেপির গেরুয়া রঙ। এবার ম্লান বিজেপির এনডিএ জোটও। কারণ, জোটেরও ৫৯টি আসন কমে গেছে। তাই জয়ের পরও পরাজয়ের স্বাদ পাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা।
ক্ষমতাসীন দল বিজেপি তথা এনডিএ জোটের এই পরাজয়ের কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে-একদিকে, অপ্রত্যাশিতভাবে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের পুনর্জাগরণ। অন্যদিকে, নরেন্দ্র মোদীর প্রশাসনিক নীতি, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, রাষ্ট্রে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, বিরোধীদের ওপর সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং কৃষক অসন্তোষ সহ নানা সমস্যা এবং দলে ও জোটে সমন্বয়হীনতা। ফলে যুক্তিসঙ্গত অনেক কারণেই মোদীর জনসমর্থন কমে গেছে। তাই এখন পরিবর্তন চায় ভারতের সাধারণ মানুষ, চায় নতুন মুখ- বলছেন বিশ্লেষকরা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবারের নির্বাচনে ‘এক ঢিলে দুই পাখি’ মারার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর টানা তিন মেয়াদে নিরঙ্কুশ জয়ের রেকর্ড ভাঙার পাশাপাশি, রাজীর গান্ধীর ৪১৩ আসন জয়ের রেকর্ড অতিক্রম করে ইতিহাসে ‘ডাবল রেকর্ড’ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি।
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৫২, ১৯৫৭ ও ১৯৬২ সালের নির্বাচনে জিতে টানা তিন মেয়াদে ১৬ বছর দেশ শাসন করেছেন। নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের প্রতিটি জয়ই ছিল নিরঙ্কুশ। কারো সহায়তা ছাড়াই তিনি সরকার গড়েছিলেন।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর নেহেরুকে অতিক্রম করার স্বপ্নপূরণ হয় নি। ২০১৪ সালের ষোড়শ ও ২০১৯ সালের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ জোটের সহায়তায় বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা পেলেও, এবারের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে জোটকে নিয়েও তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে নি। ফলে টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে মোদী নেহেরুর রেকর্ড ছুঁলেও, তাঁকে অতিক্রম করতে পারেন নি। হ্যাটট্রিকের এই নির্বাচনেও মোদীকে জোট শরিকদের সাহায্য নিতে হয়েছে, সরকার গঠনের জন্য।
অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১৯৮৪ সালের লোকসভা ভোটে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের জেতা ৪১৩ আসন টপকে নতুন রেকর্ড গড়তে চেয়েছিলেন। এজন্যই তিনি “আব কি বার, চারশ পার” স্লোগান তুলেছিলেন। এই ইচ্ছাও পূরণ হয় নি মোদীর। ভবিষ্যতেও কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। বরং এই জয় ‘অসম্মানের ও পরাজয়তুল্য’ বলে গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। এবারের নির্বাচনে মোদীর কোনো লক্ষ্য পূরণ হয়নি। নির্বাচনে জিতেও তাঁর সবচেয়ে বড় হার হয়েছে। ফলে ‘কর্তব্য পথে’ শপথ গ্রহণের অভিলাষ ছাড়তে হয়েছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে।
উল্লেখ্য, নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগে ভাবা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের হ্যাটট্রিক উদযাপন করা হবে জনতার দরবারে। সে কারণে তাঁরই আমলে নতুনভাবে তৈরি কর্তব্য পথে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব বিবেচিত হচ্ছিল। কিন্তু মোদীর কথিত অপ্রতিরোধ্য জয়রথ অপ্রত্যাশিতভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার কারণে সেই পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেছে।
এত দিন দূরবিন দিয়েও দেখতে না পাওয়া অথবা পাত্তা না দেওয়া মাঝারি, ছোট ও আণুবীক্ষণিক জোট সঙ্গীদের কাছে অবনত শিরে হাত পেতে শর্ত সাপেক্ষে সমর্থন নিয়ে এবং তাদের কাঁধে ভর করে যত দূর যাওয়া যায়—এই প্রত্যাশায় তৃতীয়বার সরকার গঠন করেছেন নরেন্দ্র মোদী। বলা যায়-কিছুটা আতঙ্ক, ভয় ও অশনি সংকেত নিয়েই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নতুন করে যাত্রা শুরু করলেন।
গত ৯ জুন রোববার সন্ধ্যায় রাজধানী নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন ‘রাইসিনা হিলস’ এ টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। শপথ বাক্য পাঠ করেছেন তাঁর নতুন এনডিএ জোট সরকারের মন্ত্রিসভার ৭২ জন সদস্যও। তাঁদের শপথ পড়ান ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু।
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।