দ্যুতিময় বুলবুল
১৫৯১ থেকে ১৫৯৫ সালের মধ্যে কোনো এক সময় উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকটি লিখেছিলেন। নাট্যকারের কেরিয়ারের প্রথম দিকে লেখা এই নাটকটি তার ৩৮টি নাটকের মধ্যে সবচে’জনপ্রিয়। এছাড়াও শেক্সপিয়ারের সর্বাধিক জনপ্রিয় নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, এন্টোনিও এ্যান্ড ক্লিওপেট্রা প্রভূতি।
শেক্সপিয়ারের এই রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট নাটকটি বিশ্বের সেরা প্রেম কাহিনীগুলোর অন্যতম। এই নাটকের কাহিনী পশ্চিম ইউরোপের দেশ ইতালির ভেনেতো প্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ভেরোনা শহরের। প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই প্রাচীন শহরটি।
রোমিও জুলিয়েটের এই গল্প জগৎ বিখ্যাত হয়েছে, সেই সুবাদে বিখ্যাত হয়েছে ভেরোনা শহরটিও। শেক্সপিয়ারের গল্প পড়ে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখনো প্রতিদিন ছুটে যায় রোমিও জুলিয়েটের ভেরোনায়। পর্যটকদের পদচারণায় সারা বছর মুখরিত থাকে ভেরোনা। তাই ভেরোনা এখন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমকানন! উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাঁর এই অমর বিয়গান্ত নাটক রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট লিখে শহরটিকে বিশ্বব্যাপী প্রেমের তীর্থক্ষেত্র বানিয়ে দিয়েছেন। ভেরোনা আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্রের মর্যাদা লাভ করেছে।
ইতালির ভাষায় ভেরোনাকে বলা হয়, ‘চিত্তা দেল্লামোরে’, অর্থাৎ প্রেমের নগরী। তাই সুযোগ পেলেই পৃথিবীর নানা স্থান থেকে প্রেমিক যুগল ছুটে যান ভেরোনায়, রোমিও জুলিয়েট এবং তাদের অমর প্রেমের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের জন্য।
সারা বছর অসংখ্য পর্যটক রোমিও এবং জুলিয়েটের বাড়ি দেখতে ভেরোনায় ভীড় করেন। হাজারো জুটি তাদের প্রেমকে স্মরণীয় করে রাখতে জুলিয়েটের মূর্তি ছুঁয়ে প্রেমের শপথ নেন। অসংখ্য দম্পতি জুলিয়েটের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান করেন। বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রেমিক যুগলের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ভেরোনার স্থানীয় পৌরসভা আলাদা জায়গায় বিয়ের স্থায়ী মণ্ডপ বানিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রেমিক প্রেমিকারা সেখানে গিয়ে উচ্চমূল্যে বিবাহ মঞ্চ ভাড়া নিয়ে বিবাহ উৎসব করেন।
আবার অনেক প্রেমিক প্রেমিকা বিয়ের পর যুগলবন্দী ছবি তুলতে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যান জুলিয়েটের বাড়ির ভেতরে। তারা জুলিয়েটের সেই বিখ্যাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরস্পরকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে চুম্বনে চুম্বনে এক আবেগঘন মুহূর্ত সৃষ্টি করে, বিয়ের অনুষ্ঠানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য।
ইতালির অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শহর ভেরোনার প্রধান চত্বর (পিয়াচ্ছা দেল্লে এরবে) সহ প্রতিটি অলিতে গলিতে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু পর্যটকদের সবচেয়ে প্রিয় স্থান জুলিয়েটের বাড়ি। শুধু জুলিয়েটের বাড়ি নয়, পাশে রোমিও’র বাড়িও তাদের অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু রোমিও’র বাড়িতে পর্যটক বা প্রেমিক প্রেমিকাদের প্রবেশের অনুমতি নেই। রোমিও’র বাড়ির ফটক সব সময় বন্ধ থাকে। ভেতরে জনসাধারণকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। দর্শকদের বাইরে থেকেই দেখতে হয়।
তাই পর্যটকরা বাহির থেকেই রোমিও বাড়ি পরিদর্শন করে ফিরে যান জুলিয়েটের বাড়িতে। কারণ, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট নাটকে নায়িকা জুলিয়েটের বাড়িটিই গল্পের প্রাণকেন্দ্র। তাই জুলিয়েটের বাড়ি সবচে’ আলোচিত ও সর্বাধিক জনপ্রিয়। ফলে প্রেম কাতর লাখ লাখ নারী-পুরুষ এই বিখ্যাত বাড়িতে প্রতিদিন ভীড় করেন।
প্রতিবছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে হাজারো চিঠি আসে জুলিয়েটের বাড়ির ঠিকানায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ওইসব চিঠির অধিকাংশ জুলিয়েটের উদ্দেশ্যে লেখা- ‘জুলিয়েট আমি তোমায় ভালোবাসি’, ‘জুলিয়েট তুমি আমার প্রেমের আইকন’, জুলিয়েট তোমার প্রেম শ্রেষ্ঠ’ ইত্যাদি। ইতালির ভাষায় রোমিওকে বলা হয় ‘রোমেও’ এবং জুলিয়েটকে বলা হয় ‘জুলিয়েত্তা’।
ভেরোনায় জুলিয়েটের ঠিকানায় প্রেমপত্র আসতে শুরু করে মূলত ১৯৩০ সাল থেকে। এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি প্রেমপত্র আসে। এসব প্রেমপত্রের তিন-চতুর্থাংশই মেয়েদের। সবচে’ বেশি প্রেমপত্র পাঠায় মার্কিন কিশোরীরা। ভেরোনা শহর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ১৯৮০-এর দশকে ক্লাব ডি জিউলিয়েতা (জুলিয়েট ক্লাব) চালু হয়। এই ক্লাবের পক্ষ থেকে স্থানীয় সেচ্চাসেবীরা প্রেমপত্র পড়ে উত্তর দেন।
উল্লেখ্য, জুলিয়েট ক্লাবটি নিয়ে লিসা ও চেইল ফ্রিডম্যানের একটি বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া সুজানা হারপারের একটি বইয়েও এই ক্লাবের তথ্য রয়েছে। আর ২০১০ সালের মার্কিন চলচ্চিত্র ‘লেটারস টু জুলিয়েট’ চলচ্চিত্রের কাহিনী তো এই ক্লাবটিকে উপজীব্য করেই তৈরি করা হয়েছে।
জুলিয়েটের বাড়ির একটি কক্ষ বিভিন্ন পেইন্টিংয়ে ঠাসা। সেখানে ক্যামেরার আলো জ্বেলে ছবি তোলা নিষেধ। পুরনো আমলের কিছু চেয়ার টেবিল আছে ওই কক্ষে। কিন্তু সেগুলো বসার জন্য না, দেখার জন্য। এই কক্ষের সঙ্গে যুক্ত ছোট্ট একটি বেলকনি। এটাই সেই বিখ্যাত বেলকনি, যেখানে দাঁড়িয়ে জুলিয়েট তার প্রেমিক রোমিওকে দেখার জন্য, তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল।
সেই বেলকনিতেই পর্যটক প্রেমিক প্রেমিকারা একে অপরকে উষ্ণ আলিঙ্গন ও চুম্বন করেন। কেউ কেউ বালকনিতে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমিককে ইশারা করেন তার নাম ধরে ডাকার জন্যে। বাইরে দাঁড়িয়ে শতশত প্রেমিক তাদের প্রেমিকাকে ‘জুলিয়েট’বলে একযোগে চিৎকার করে ডাকেন।
পরের কক্ষ জুলিয়েটের শয়নকক্ষ। সেখানে সুসজ্জিত কাঠের খাট, জুলিয়েটের পোশাক, রোমিও’র পোশাক এবং দু’জনের যুগলবন্দী ছবি। খাটের ওপর নকশা করা তোষক ও বিছানার চাদর। কাঁচের আলমারির পোশাকগুলো কয়েকশ’ বছরের পুরনো। শয়নকক্ষের দেয়ালের কারুকার্যগুলোও অসাধারণ। কিছু অংশের পলেস্তারা খসে পড়েছে। তার পরেও প্রাচীন ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের ছাপ। বিত্ত, বৈভব এবং ঐতিহ্য, আভিজাত্যের প্রমাণ ও নিদর্শন থরে থরে সাজানো।
একটি কক্ষে জুলিয়েটের ব্যবহৃত বিভিন্ন গৃহসামগ্রী। এর মধ্যে থালা-বাসন, ঘটি-বাটি, ঘড়া- কড়া ইত্যাদি। যার প্রত্যেকটি ষোড়শ শতকের সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে। দেয়াল জুড়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা জুলিয়েটের ছবি। অধিকাংশই ন্যুড-বিছানায় শুয়ে, বসে, বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। এছাড়াও অনেক ধরনের পেইন্টিং, শীতের দিনে কাঠ পুড়িয়ে ঘর গরম করার পুরনো চুল্লিসহ দেখার মতো অনেক কিছুই আছে, এই জুলিয়েট জাদুঘরে।
বাড়ির আঙ্গিনায় জুলিয়েটের একটি বিরাট ব্রোঞ্জ মূর্তি। মূর্তিটির বুক খোলা। দর্শনার্থী প্রেমিক প্রেমিকারা মূর্তির ডান স্তনে হাত রেখে ছবি তোলে। তারা বিশ্বাস করে জুলিয়েটের (মূর্তির) ডান স্তনে হাত রাখলে প্রেম বাসনা পূর্ণ হয়! বিখ্যাত ওই মূর্তির সঙ্গে ছবি তুলতে কোনো টিকিট লাগে না। সেই মূর্তির পেছনে ইতালির একটি ডুমুর (ফিকি) গাছ। মনে হয়, গাছের ছায়ায় জুলিয়েট দাঁড়িয়ে আছে।
জুলিয়েটের বাড়ির প্রধান ফটক থেকে শুরু করে গোটা আঙ্গিনার দেয়াল জুড়ে প্রতিদিন অসংখ্য ছোট ছোট চিরকুট লাগায় প্রেমিক প্রেমিকারা। ওইসব চিরকুটে তারা ভালোবাসা নিয়ে নানা উক্তি লিখে টানিয়ে রাখেন। অনেকে সরাসরি কলম দিয়ে অথবা দেয়ালে চুইংগাম লাগিয়ে ভালোবাসার মানুষের নাম লেখেন, লাভ চিহ্ন আঁকেন।
ইট সুরকির গাঁথুনিতে নির্মিত জুলিয়েটের বাড়ির অনেকটা পাথরের তৈরি। যে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জুলিয়েট প্রেমিক রোমিও’র অপেক্ষায় থাকতো, সেটাও কারুকাজ করা পাথরে নির্মিত। অবশ্য বাড়ির বাইরের দেয়ালের অধিকাংশ জায়গার এখন পলেস্তারা খসে পড়েছে। তবে বাড়িটির নয়নাভিরাম কারুকার্য এবং আভিজাত্য সুস্পষ্ট। জুলিয়েটের ব্যবহৃত যে থালা বাটি রাখা হয়েছে, সেগুলো ষোড়শ শতকের পোড়া মাটি এবং কড়ি মাটির তৈরি। সব মিলিয় পুরো বাড়িটাই রোমান সভ্যতার ঐতিহ্য বহন করে।
জুলিয়েটের বাড়ির লোহার গেটসহ যেখানেই সুযোগ পান, পর্যটক প্রেমিক প্রেমিকারা ছোট ছোট হাজারো তালা ঝুলিয়ে রাখেন। ভালোবাসার চিহ্ন আঁকা তালার ওপর নিজেদের নামের প্রথমাক্ষর লিখে আটকে দেন। কারণ, ইউরোপীয় প্রেমিক প্রেমিকারা এক সময় বিশ্বাস করতেন যে, নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় তালা লাগিয়ে চাবি পানিতে ফেলে দিলে ভালোবাসার বন্ধন অটুট হয়! সেই বিশ্বাস থেকেই তাদের এই তালা সংস্কৃতি। শুধু ভেরোনায় নয়, ইউরোপের অনেক শহরে প্রেমিক প্রেমিকাদের হাজার হাজার তালা ঝুলাতে দেখা যায়।
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিত, গবেষক।