একটি ত্রিভুজ প্রেমের দম্পতির জবানবন্দী

Spread the love

দ্যুতিময় বুলবুল

একাদশ পর্ব

সত্যিকারের ভালোবাসা ও বিশ্বাসের বন্ধন দাম্পত্য সম্পর্ক দৃঢ় করে। এই বন্ধন পরস্পরের জীবন সুখ, শান্তি, সম্মান এবং আনন্দে ভরিয়ে দেয়। কারণ, সংসারটা স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই। তাদের যৌথ প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা এবং একে অন্যের প্রতি সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধ সংসার জীবন সুন্দর ও সুখী করে।

সংসার যেহেতু স্বামী-স্ত্রী দু’জনের, কারও একার নয়। তাই সংসারের দায়িত্ব দু’জনকে সামলাতে হয়, সমানভাবে। আসলে সুখী সংসার হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের একটি কোয়ালিশন ব্যবস্থা। সুখের সংসারে থাকে হাসি-খুশি, সুখ-শান্তি ও আনন্দ-উল্লাসের ধর্ণাধারা, যতদিন না প্রকৃতির নিয়মে কালের অমোঘ বিধানে বিনে সুতার বন্ধন ছিঁড়ে যায়।

তবে পরিবারের কল্যাণে, দাম্পত্যের সম্পর্কে কড়া নজর রাখা উচিত-যাতে ‘তৃতীয় শক্তি’ ঢুকে না পড়ে। একটি দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় শক্তির অনুপ্রবেশ সুখের সংসার ছারখার করে দেয়। বাইরের শক্তি বা তৃতীয় শক্তি অথবা কোনো পক্ষ কিম্বা পারিপার্শ্বিক কোনো এজেন্ট দাম্পত্য সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই মহান দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, মানুষকে সুখী হতে হলে তাকে নৈতিক হতে হবে ও সদগুণের অধিকারী হতে হবে; অনৈতিকতা কখনোই সুখের সন্ধান দিতে পারে না।

কারণ, বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বন্ধনের মূল ভিত্তি হলো- পারস্পরিক ভালোবাসা, বিশ্বস্ততা, জবাবদিহিতা, একতা, সততা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা। তাছাড়া উভয়কে পরস্পরের অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হয়। মূলত দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা দাম্পত্যের চাবিকাঠি।

দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা মানে শুধু নিজে ভালো থাকা নয়। দাম্পত্য ভালোবাসা মানে, ভালোবাসার মানুষটাকেও ভালো রাখা। ভালোবাসি বলা সহজ। কিন্তু ভালোবেসে কারো পাশে সারাজীবন থাকাটা সহজ নয়। কারণ, সবাই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারে না।

একজন খাঁটি প্রেমিক, যার একটা সত্যিকারের প্রেমিক মন আছে, সে কখনো একসঙ্গে একাধিক জনকে ভালোবাসতে পারে না, বরং সে একজনকেই নানাভাবে ভালোবাসে। তার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড প্রেমিকার জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন। অর্থাৎ রাজত্বের চেয়ে তিনি ভালোবাসাকে বেশি মূল্য দিয়েছিলেন। এডওয়ার্ডেরই পরবর্তী প্রজন্মের উত্তরসূরী প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়নার দ্বিতীয় পুত্র প্রিন্স হ্যারি রাজ পরিবারের রাজচক্ষু উপেক্ষা করে মেগান মার্কেলকে বিয়ে করেছেন। ভালোবাসার জন্য তিনি রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেছেন। সাধারণদের মধ্যেও ভালোবাসার এমন নজির ভুরি ভুরি।

আসলে ভালোবাসার মানুষকে কখনো কাঁদাতে নেই। ভালোবাসার মূল্য দিতে হয়। কারণ, একজন নারী কিংবা পুরুষ ভালো থাকার জন্য বিশ্বাস করে প্রিয়জন বেছে নেয়। সেই বিশ্বাসে অমর্যাদা করা ঠিক না। যেখানে দু’জনের প্রতি দু’জনের বিশ্বাস ও সম্মান থাকে, সেখানে ভালোবাসা থাকে প্রাণবন্ত। অবশ্য এমন নজির খুব কম। বরং যারা সত্যিকারভাবে ভালোবাসতে চায়, তাদের ভাগ্যে কখনো ভালোবাসা জোটে না। অথচ জীবনে ভালোবেসে সুখী হওয়ার জন্য পুরো পৃথিবীর দরকার হয় না। শুধু একজন মনের মতো মানুষ হলেই চলে। কারণ, ভালোবাসার সমসত্ত্ব দ্রবণের ঘনত্ব সমানুপাতিক।

কিন্তু কিছু মানুষ আছে, যারা সারাজীবন অপেক্ষা করেও সত্যিকারের ভালোবাসা পায় না। আবার কিছু মানুষ, খুব সহজে ভালোবাসা পেয়েও-তাকে অবহেলা করতে শুরু করে। আসলে ভালোবাসা যখন মানুষকে ঘিরে থাকে, তখন মানুষ ভালোবাসার মূল্য বুঝতে পারে না। মূল্য বুঝতে পারে তখনই, যখন সে ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে। তাই ভালোবাসা কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু ভালোবাসা নিয়ে খেলা করাটা অপরাধ। কারণ, ভালোবাসা এমনই দুর্লভ যে কেউ চেয়েও পায় না, আবার কেউ সত্যিকারের ভালোবাসা পেয়েও তার গুরুত্ব বোঝে না।

তাই সত্যিকারের ভালোবাসার সম্পর্ক বেশিদিন বাঁচানো কঠিন। কারণ, যারা সত্যিকারের ভালোবাসা পায়, তারা সেই ভালোবাসা ধরে রাখতে পারে না। তারা ভালোবাসা আশা করে, কিন্তু তাদের অতিরিক্ত চাহিদা, প্রত্যাশা ও সম্পর্কের প্রতি অবহেলা ভালোবাসাকে দুর্বল করে ফেলে। পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। ফলে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মানুষটি চরম দুঃখ পায়। অতিরিক্ত ভালোবাসা একদিন অতিরিক্ত একা করে ফেলে। কারণ, সত্যিকারের ভালোবাসার মূল্য কেউ দেয় না। বরং সেই ভালোবাসার মানুষটিকে দুর্বল ও সস্তা ভেবে শাস্তি দেয়।

শ্যামলীর আত্মজিজ্ঞাসা, আমিও তো ভালোবেসে সুখি হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল কেন? এতো সুন্দর একটা সংসারে কেন আজ অশনি সংকেত? আমি তো একটা সাধারণ মেয়ে। কোনো উচ্চাভিলাস নেই। লোভ নেই, লালসা নেই। শুধু স্বামী এবং সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই সুখ-শান্তি পেলাম কোথায়? ষোড়শ শতকের পদাবলী সাহিত্যের কবি জ্ঞানদাসের ভাষায় বলতে হয়, ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল।’

আসলে সুখ সবার জীবনে সয় না। সুখে সবাই থাকতে চায়, কিন্তু কতজন সুখে থাকে? বেশিরভাগ মানুষের জীবনে সুখ আসে না বা স্থায়ী হয় না। কারণ, অধিকাংশ মানুষ ঘরে নয়, বাইরে সুখ-শান্তি খোঁজে। তাই বাইরে সুখ খুঁজতে গিয়ে ঘরের সুখ নষ্ট হয়। কিন্তু ঘরে-বাইরে কোথাও কোনো সুখ নেই, যদি না আনন্দের কেমিষ্ট্রি তৈরি হয় নিজের মনে মধ্যে, পরিবারের মধ্যে। দূর থেকে যাকেই সুখী বলে মনে হয়- কাছে গেলে দেখা যায়, তারও দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই।

আসলে সুখের সঠিক সংজ্ঞা নেই। কারণ, সুখ হচ্ছে আপেক্ষিক বিষয়। এটা একেক জনের কাছে একেক রকম। কারণ, কেউই তার নিজ অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তাই জীবনে কোথাও সুখ খুঁজে পাওয়া যায় না। এজন্যই কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ক্ষণিকা’ কাব্যে ‘মোহ’ কবিতায় বলেছেন,“ নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,/ ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।/ নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;/ কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে। “ (চলবে)

দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।