দ্যুতিময় বুলবুল
দ্বাদশ পর্ব
শ্যামলী মনে মনে ভাবেন, সোমেন ঘরের বাইরে অলিক স্বপ্নের সুখ খুঁজতে গিয়ে, আমার জীবন ও পরিবারের সুখ কেড়ে নিয়েছে। আজ চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। সংসার ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইলেও, মনে হচ্ছে আমার দুই পা শিকলে বাঁধা। কিন্তু কীভাবে আমার জীবনে আবার সব স্বাভাবিক হবে? এই প্রশ্নটা মনে ঝড় তুললেও, উত্তর নেই আমার কাছে। তবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, পরিস্থিতি মানুষকে অনেক কিছু শেখায়, যেমন একা চলতে শেখায়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখায়। বাস্তবতা শেখায়। চেনা মানুষের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখোশও উন্মোচন করতে শেখায়।
আমি একদিন ভেবেছিলাম- প্রেম, বিয়ে এবং সংসার হচ্ছে, আধুনিক সমাজের একমাত্র পরিশীলিত সমাধান। তাই যথেষ্ট শিক্ষা ও যোগ্যতা অর্জনের পরও, চাকরিতে না গিয়ে বিয়ের পর সোমেনকে বিশ্বাস করে পরিবার গঠন ও সংসার সামলানোর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। পুরো জীবন বাচ্চা জন্ম দেয়া, বাচ্চাদের খেয়াল রাখা, তাদের পড়াশুনা করানো, স্বামী-সন্তানের জন্য রান্না-বান্না করা, তাদের খাওয়ানো, বাড়ি-ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং স্বামীর দেখভাল ও তার চাহিদা পূরণ করা-এই সব করতেই ১৫ বছর কেটে গেছে। কিন্তু আজ কী দেখছি? পুরোটাই অন্তঃসারশূন্য। আসলে পৃথিবীতে তারাই বেশী কাঁদে, যারা অন্যের মতো একাধিক জনকে নয়, শুধু একজনকে মনে-প্রাণে ভালোবাসে।
আত্মসম্মান রক্ষার জন্য আজ এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চাই না। নিজ উদ্যোগে ঘর ভাঙতেও চাই না। আমি আমার সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান বজায় রাখতে চাই। তাই আমি এ বিষয়ে আইনি সহায়তা নিতে যাব না। তাছাড়া আমি সোমেনের বিয়ের বিষয়টিও প্রচারে আনতে চাই না। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে- কখনোই হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না, ব্যক্তিত্ব ঠিক রেখে একটি সম্মানজনক সমাধানের জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতে হবে।
তাই সোমেন কিংবা আমার, কোনো পরিবারকেই এ ব্যাপারে জড়াতে চাই না। সোমেন যদি আমার কথা, সংসারের কথা, সন্তানদের কথা না ভাবে, আমাদের যন্ত্রণা অনুভব না করে, তাহলে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি, তাকে ফেরাতে পারবে না। বরং তাতে হিতে বিপরীত হবে। অশান্তি বাড়বে। সোমেন নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। আর দুষ্ট লোকেরা এতে মজা পাবে। তাই এই সমস্যাটা যেহেতু আমার, লড়াইটাও আমার। আমাকে নিজের চেষ্টায় এই দুঃসময় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, আমার নিজের মতো করে।
তাই সোমেন আমাকে ত্যাগ করবে নাকি আমি তাকে ত্যাগ করব, সেটা নিয়ে এখন ভাবতে চাই না। আমি একজন পরিত্যক্ত বা অনাকাঙ্ক্ষিত নারী অথবা আমি একজন সংসার ত্যাগী নারী-কোনোটাই এই মুহূর্তে আমার ভাবনা বা প্রত্যাশা না। কেউ যদি সংসার, সন্তান ও ভালোবাসার মূল্য না বোঝে; তবে নিজেকে অসহায় ও নিঃস্ব ভাবারও কোনো কারণ নেই।
জীবনটা এত তুচ্ছ নয়। ফেলনা নয়। খেলনাও নয়। জীবনটা অনেক সুন্দর, অনেক বড়। জীবনের মূল্যটাও অনেক বেশি, যদি নিজের মতো করে বাঁচা যায়। যদিও সবাই নিজের মতো করে বাঁচতে চায়, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ক’জন মানুষ নিজের মতো করে বাঁচতে পারে? আর মানুষ চাইলেই কি তা সব সময় সম্ভব?
তাই এত কিছুর পরও, আমি সোমেনকে ছেড়ে যাব কিনা এখনো সিদ্ধান্ত নেই নি। কিন্তু ওকে এখন আমার মনে মনে ঘৃণা হয়। এক মুহূর্ত একসঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে না। তবু আমি এই সম্পর্ক নিজে থেকে ভাঙতে পারব কিনা জানি না। কারণ, আমার পায়ের তলার মাটি শক্ত নয়। শিক্ষা থাকলেও, এই মুহূর্তে আমার কোনো আয়-উপার্জন নেই। এছাড়াও, আমাদের দুটি সন্তান আছে। ওদের ওপর কী প্রভাব পড়বে, সেই কথাও আমাকে ভাবতে হবে। তাই এখনো জানি না-আমি কী করব, আমার চলার পথের শেষ কোথায়, বাকি জীবনের ঠিকানা কোথায়-সেটাই আগে আমাকে ঠিক হবে। (চলবে)
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।