ইয়ামাল ফাইনালে স্পেনের জয়ের স্বপ্নে বিভোর

Spread the love

বাঙালিনিউজ, খেলারডেস্ক

লামিনে ইয়ামাল, এখন বিশ্ব ফুটবলের আলোচিত তারকা। ইউরোয় সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে শুধু মাঠে নামার রেকর্ডই গড়েননি ইয়ামাল, সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ডও গড়েছেন, চোখধাঁধানো গোলে। আর সেটাও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জার্মানির মাঠে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৪ এর সেমিফাইনালের মতো ম্যাচে।

ইয়ামাল প্রমাণ করেছেন তিনি ‘সাবালক’হয়েছেন। বায়োলজিক্যাল বয়স ১৬ বছর হলেও, ফুটবলে প্রবল সাবালক তিনি। এত দিন তাকে সবাই বলতেন দুর্দান্ত প্রতিভা। স্পেনের বিস্ময় বালক দেখিয়ে দিলেন, শুধু প্রতিভা হয়ে থাকতে আসেননি তিনি। ইউরো কাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্সের মতো দলের বিরুদ্ধে যে খেলাটা তিনি খেললেন, তা দেখে অবাক হতে হয়।

গোল করলেন। ইউরোর ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হলেন। বার বার গোলের সুযোগ তৈরি করলেন।  পিছিয়ে পড়েও ফ্রান্সকে হারায় স্পেন, তার গোলে। ফলে ইউরো কাপের ফাইনালে উঠেছে। সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হলো কিলিয়ান এমবাপের ফ্রান্সকে।

ফ্রান্সের সঙ্গে সেমিফাইনাল ম্যাচের ২১ মিনিটে জাদু দেখান ইয়ামাল। বক্সের বাইরে বল পেয়ে দুই ডিফেন্ডারকে নাচিয়ে ছাড়েন তিনি। প্রথমে ডান দিকে ঘুরে চকিতে বাঁ দিকে ঘোরেন। ফলে দুই ডিফেন্ডার কেটে যায়। ইয়ামাল বুঝতে পারেন গোলের সুযোগ রয়েছে। বাঁ বায়ে বাঁক খাওয়ানো শট মারেন তিনি।

১০২ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে মারা সেই শট ফরাসি গোলরক্ষক মাইক মাইগনান বাঁচাতে পারেননি। বল জালে জড়িয়ে যায়। ইউরোয় নিজের প্রথম গোল করে স্পেনকে সমতা ফেরান ইয়ামাল। কিন্তু গোল করে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি ইয়ামাল। সতীর্থকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। তার আবেগ বুঝিয়ে দিচ্ছিল এই গোলের গুরুত্ব তার কাছে কতটা।

ইয়ামালের জন্ম ২০০৭ সালের ১৩ জুলাই কাতালুনিয়ান শহর মাতারোয়। তার বাবা মরোক্কান এবং মায়ের বাড়ি বিষুবীয় গিনি। ২০১৪ সালে মাত্র সাত বছর বয়সে ফুটবল পায়ে যাত্রা শুরু এই কিশোর উইঙ্গার ইয়ামালের। তাই ২০১৪ সাল থেকে বার্সেলোনায় স্থায়ী ভাবে থাকতে শুরু করে ইয়ামালের পরিবার।

তখন তাঁকে ভর্তি করানো হয় বার্সেলোনার ফুটবল অ্যাকাডেমিতে। সেখানেও প্রথম থেকেই নজর কেড়ে নেয় তাঁর প্রতিভা। স্পেনের প্রতিটি বয়সভিত্তিক দলের হয়ে প্রতিভার পরিচয় দেওয়া ইয়ামালকে ছোট বয়সেই জাতীয় দলের হয়ে খেলার প্রস্তাব দিয়েছিল মরক্কোর ফুটবল সংস্থা।

ইয়ামাল বেছে নিয়েছেন নিজের জন্মভূমিকে। স্পেনের জল-হাওয়ার সঙ্গে তাঁর পরিচয় জন্ম থেকে। নিজেকে স্পেনীয় ভাবতেই পছন্দ করেন। বাবা-মায়ের মিশ্র সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা ‘উদ্বাস্তু’ ইয়ামালকে নিজের করে নিতে দু’বার ভাবেনি স্পেনও।

বার্সেলোনার ফুটবল একাডেমি ‘লা মাসিয়া’র বয়সভিত্তিক দল থেকে তাকে বার্সার মূল দলে নিয়ে এসেছেন সাবেক কোচ জাভি হার্নান্দেজ। তিনি হিরে চিনতে পেরেছিলেন। তাই কিশোর ইয়ামালকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসেন। জাভি যে ভুল করেননি, তা আজ প্রমাণিত।

ইউরোয় ইয়ামাল যা দেখাচ্ছেন, তাতে তার বাবা নাসরাউয়ি খুব খুশি। ছেলের এমন পারফরম্যান্সের পর ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি গ্যারি লিনেকারের কথাটাও নিশ্চয়ই শুনেছেন নাসরাউয়ি, ‘একজন মহাতারকার জন্ম হলো।’ তাহলে কেন তিনি খুশি হবেন না?

বাবা হিসেবে নাসরাউয়ি যে এখন ভীষণ গর্বিত, সেটা বোঝা যায় স্পেনের সংবাদমাধ্যম মুন্দো দেপোর্তিভোর সঙ্গে তার আলাপচারিতায়। এবারের ইউরোয় ছেলের পারফরম্যান্স নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আর সবার মতো আমিও আনন্দ নিয়ে উপভোগ করছি। আমরা ফাইনালে উঠেছি এবং স্পেনের সব খেলোয়াড়ের জন্য গর্ব লাগছে।’

নাসরাউয়ি বলেছেন, ইয়ামালের জন্মের পরই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ছেলে একদিন বড় কিছু হবে। তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম সে তারকা হয়ে উঠবে। বাবারা এমনই মনে করেন এবং যেকোনো বাবাই চান তার সন্তান সেরা হয়ে উঠুক। আমি তার জীবনে সেরাটাই কামনা করি ও আশা করি যেন ইউরো জিততে পারে, তাতে আমরাও চ্যাম্পিয়ন হব।’

নাসরাউয়ি জানিয়েছেন, ১৬ বছর বয়সী ইয়ামাল নিজেও এখন খোশমেজাজে আছে। তার বাবার ভাষায়, ‘লামিনে উচ্ছ্বাসের মধ্যে আছে। অন্য সব খুদেদের মতো সে–ও সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে ইউরো জিততে চায়।’

কিছুদিন আগে ইনস্টাগ্রামে নাসরাউয়ির পোস্ট করা একটি ছবি ভাইরাল হয়। ছবিতে দেখা যায়, প্লাস্টিকের একটি বড় গামলার মধ্যে ছয় মাস বয়সী শিশু ইয়ামাল। লিওনেল মেসি সেই গামলার পাশে আয়েশ করে শিশু ইয়ামালকে গোসল করাচ্ছেন। ক্যাপশনে নাসরাউয়ি লিখেছিলেন, ‘দুই কিংবদন্তির যাত্রা শুরু।’ ইউরোর সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ইয়ামালের দুর্দান্ত সেই গোলের পর ছবিটি ভাইরাল হয়।

নাসরাউয়ির কাছে সেই ছবির ব্যাপারেও জানতে চাওয়া হয়েছিল। কেউ কেউ বলছেন, তখন ২০ বছর বয়সী মেসির স্পর্শ কিংবা আশীর্বাদে ইয়ামাল আজ তারকা হয়ে উঠেছেন। নাসরাউয়ি এ প্রসঙ্গে মজা করলেও তার আগে বলেছেন, ‘মেসির ছবিটি জীবনের কাকতালীয় ব্যাপার। তার যেখানে পৌঁছানোর কথা, সে তা পেরেছে।’এরপরই নাসরাউয়ির কাছে জানতে চাওয়া হয়, ইয়ামাল কি তবে মেসির আশীর্বাদপুষ্ট?

এই প্রশ্নে শুধু ইয়ামালের বাবা নন, পৃথিবীর সব বাবাই সম্ভবত একই উত্তর দিতেন। নাসরাউয়ির মুখেও একই কথা, তবে একটু মজার ছলে, ‘কিংবা মেসিই হয়তো আমার সন্তানের কাছ থেকে আশীর্বাদপুষ্ট। আমি জানি না। আমার কাছে আমার সন্তান সবকিছুতেই সেরা। সেটা শুধু ফুটবল নয়, ভালোবাসা, ব্যক্তি—সবকিছুতেই।

ইউরোর ফাইনাল মাঠে বসে দেখতে চান নাসরাউয়ি। আগামী ১৫ জুলাই রোববার বাংলাদেশ সময় রাত একটায় বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ফাইনালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হবে স্পেন। এই ম্যাচ নিয়ে নাসরাউয়ি বলেছেন, ‘শনিবার (স্থানীয় সময়) সকালে আমি জার্মানি যাচ্ছি। আশা করছি (শিরোপা) জেতা পর্যন্ত থাকব।’

স্পেনের অনূর্ধ্ব ১৫, ১৬, ১৭, ১৯ সব দলের হয়ে খেলেছেন ইয়ামাল। জাতীয় দলের হয়েও খেলে ফেললেন ১৩টি ম্যাচ। তিনিই এখন ইউরো কাপের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা। ইউরোর ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হওয়ার নজির গড়লেন। এই সবের সঙ্গেই বুঝিয়ে দিলেন, শুধুমাত্র প্রতিভা হয়ে থাকতে আসেননি। আগামী বেশ কয়েক বছর শাসন করতে চান ফুটবল বিশ্বকে। ফুটবলজীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে লিয়োনেল মেসি। তাঁর অবসরের আগেই বিশ্ব ফুটবলকে বার্সেলোনার উপহার ইয়ামাল। মেসির মতোই বার্সেলোনার অ্যাকাডেমি লা মাসিয়ায় ফুটবলে পায়ে খড়ি স্পেনের ১৬ বছরের উইঙ্গারের। শুধু ভাল ফুটবলার নয়, ফুটবলের জাদুকর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে ইয়ামালের মধ্যে। ইউরো সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তাঁর গোলই প্রমাণ।

ইয়ামালের গোল চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তাঁর সতীর্থ পেদ্রি। এমন গোলও সম্ভব! ইয়ামালের পক্ষেই বোধহয় সম্ভব। রিজার্ভ বেঞ্চে বসা পেদ্রির বিস্ময় ভরা চোখ আর দু’গালে হাত দেওয়া মুখের ছবি ভাইরাল হতে সময় লাগেনি।মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোদের সঙ্গে তুলনা করার মতো জায়গায় এখনও আসেননি। কয়েক বছরের মধ্যে সেই জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারেন ফুটবলের নতুন বিস্ময়।

স্পেনের মাটারা প্রদেশে এক উদ্বাস্তু পরিবারে জন্ম ইয়ামালের। দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা। ইয়ামালের বাবা মরক্কোর মানুষ। মা আফ্রিকার ছোট্ট দেশ ইকোয়াটোরিয়াল গিনির। জন্মের পর থেকে তাঁর জীবন সহজ ছিল না। বিভিন্ন সময় তাঁর পরিবারকে বাস বদলাতে হয়েছে।

নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই বিকশিত হয়েছে তাঁর ফুটবল প্রতিভা। সাত বছর বয়সে লা মাসিয়ায় যাওয়ার আগেই ফুটবলার ইয়ামালকে চিনে ফেলেছিল মাটারার অলিগলি। পাড়ায় পাড়ায় ‘সেভেন এ সাইড’ ফুটবল খেলতেন তিনি। খেলতেন বড়দের সঙ্গেই।

ইয়ামালের পেশাদার ফুটবলজীবন শুরু ২০২৩ সালে। সবেই শুরু করেছেন। বলা যায় ফুটবলজীবনের চৌকাঠ পেরিয়েছেন সবে। চৌকাঠে দাঁড়িয়েই যে কেরামতি দেখাচ্ছেন, তাতে নিশ্চিত ভাবে বহু জাদু দেখাবে তাঁর বাঁ পা। বাঁ পায়ের ফুটবলারদের খেলা একটু বেশিই নান্দনিক হয়। ইয়ামালও ব্যতিক্রম নন।

এ বারের ইউরো খেলতে এসে সমস্যায় পড়েছেন ইয়ামাল। জার্মানির শিশুশ্রম আইনের কবলে পড়তে হয়েছে তাঁকে। ৯০ মিনিট তাঁকে মাঠে রাখা যাচ্ছে না। স্পেনের কোচ লুইস ডে লা ফুয়েন্তে তাঁকে তুলে নিচ্ছেন সুযোগ মতো। জার্মানির শিশুশ্রম আইন অনুযায়ী, নাবালকদের স্থানীয় সময় রাত ৮টার পরে কাজ করানো বেআইনি। খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে সময়সীমা রাত ১১টা পর্যন্ত।

যে সময় খেলা শুরু হচ্ছে, তাতে পুরো ৯০ মিনিট খেলালে জার্মানির আইন অনুযায়ী ম্যাচ প্রতি ২৭ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে স্পেনকে। এই কড়া আইনও রুখতে পারছে না তাঁকে। সেমিফাইনালে যেমন পারল না কিলিয়ান এমবাপের ফ্রান্স।

যদিও ফুয়েন্তে জানিয়ে দিয়েছিলেন, প্রয়োজন মনে করলে পুরো ম্যাচই খেলাবেন ইয়ামালকে। জরিমানা দিতে হলে দেবেন। আইনের তোয়াক্কা করবেন না। আইনের প্যাঁচে ফেলে তাঁর সেরা অস্ত্রকে ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা সফল হতে দেবেন না।

সূত্র: অনলাইন নিউজ।