দ্যুতিময় বুলবুল
বাবা, আব্বা, বাপি, ফাদার, ড্যাড, ড্যাডি ইত্যাদি নানা নামে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় সন্তানরা পিতাকে সম্বোধন করেন। বাবা শব্দের প্রতিশব্দ হলো – জনক, জন্মদাতা ইত্যাদি। ভাষা, সংস্কৃতি ও দেশ ভেদে বাবা ডাক বদলে গেলেও-কখনো বদলায় না বাবা ও সন্তানের রক্তের টান, প্রাণের সম্পর্ক, জন্মের বন্ধন। বাবা শব্দটি উচ্চারণ করলেই এক অকল্পনীয় আবেগ ও অনুভূতিতে শরীরের শিরা, উপশিরা ও ধমনীতে রক্তে শিহরণ জাগে। সন্তানের দু’চোখ বেয়ে আনন্দ-বেদনার অশ্রু ঝরে।
আমাদের বাংলা ভাষায় বাবা দুটি বর্ণের একটি ছোট্ট প্রেমময় শব্দ। এই শব্দটি পরম নির্ভরতা, স্নেহ, মায়া, মমতা, সাহস ও শক্তির আধার। জন্মের পর থেকে সন্তানকে অপরিসীম আদর-যত্নে আগলে রাখেন বাবা। তাই বাবা মানেই অনন্ত ভালোবাসা, অফুরন্ত শ্রদ্ধা, অশেষ ভক্তি। বাবাকে নিয়ে নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ লিখেছেন, ‘নিজের অস্তিত্বে বাবার অবয়ব ফুটে উঠতে থাকে বলেই মানুষ ক্রমেই বড় হতে থাকে।’
বাবা সন্তানের আশা ভরসার সবচে’ নির্ভার আশ্রয়। সত্য ও বিশুদ্ধ ভালোবাসার ঠিকানা। সুখ-দুঃখের পরম মিত্র, পথ প্রদর্শক ও ধ্রুবতারা। শাশ্বত প্রেমের চিরন্তন প্রতীক। সবচে’বড় ও সর্বাধিক বিশ্বস্ত বন্ধু, স্বজন, প্রিয়জন, চির আপন। সন্তানের গর্ব, আদর্শ, ছায়া, কায়া, প্রাণের মানুষ। বাবা হলেন সবচে’ ধৈর্যশীল, সদয় ও প্রেমময় ব্যক্তিত্ব। তিনি সন্তানের মধ্যে নিজের আশা, ভরসা ও প্রত্যাশার স্বপ্ন বোনেন। চিন্তা-চেতনায় মননশীল ও সৃজনশীল ভাবনার চাষ করেন। তিনি সন্তানের হৃদয়ে চিরকালের মহানায়ক। অতুলনীয়, অনুকরণীয়, অসাধারণ মহামানব।
বাবা নিঃস্বার্থ সংগ্রামী, সর্বস্ব ত্যাগী, আমৃত্যু জীবনযোদ্ধা। সন্তানের সুখের জন্য, শান্তির জন্য, মঙ্গলের জন্য, নিজের সব কিছু বিসর্জন দেন তিনি। সন্তানের যত চাহিদা, যত আবদার, সব প্রয়োজন মিটাতে রাতদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। বাবা সন্তানের কাছে বটবৃক্ষ, অমল-ধবল কাশবনের শীতল পরশ। নির্ভরতার চক্রব্যূহ, নিরাপত্তার লক্ষণরেখা। আদর-শাসন ও বিবেকের কাণ্ডারী। বাবা সন্তানের চেতনা, প্রেরণা এবং নীতি ও আদর্শের আলোকবর্তিকা।
বাবার কল্যাণেই সন্তানের পৃথিবীর রূপ, রস, রঙ, গন্ধ উপভোগ ও আলোর দর্শন। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত অপ্রতিদ্বন্দ্বী সত্ত্বা বাবা। হাজারো দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে বরণ করেন তিনি। তাঁর ভালোবাসার গভীরতা ও বিশালতা সীমাহীন, অপার-অসীম, গভীর-গহীন। সন্তানের প্রতি বাবার প্রেম অপরিমেয়, অকৃত্রিম, স্বার্থহীন। বাবার ঋণ কখনো শোধ হয় না। কারণ, সাগরের জল সেচে কখনও শেষ করা যায় না।
জীবনে যতই বাধা-বিপত্তি আসুক, দুঃখ আসুক, সব পরিস্থিতিতেই পরম মমতায় সন্তানকে আগলে রাখেন বাবা। বাবার তুলনা বাবা নিজেই। বাবার আর্দশ সন্তানকে ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে শেখায়। একজন বাবা ১০০ শিক্ষকের সমান। পৃথিবীতে একমাত্র বাবাই নিজের চেয়ে সন্তানের সাফল্য বেশি কামনা করেন। বাবা সন্তানকে ততটাই সফল করতে চান, যতটা তিনি হতে চেয়েছিলেন। বাবা তার ছেলের কাছে প্রথম হিরো এবং মেয়ের কাছে প্রথম ভালোবাসা।
তাই সব ধর্মেই বাবার সন্তুষ্টির কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কোরানে মহান আল্লাহ বলেছেন, “তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, তাঁকে ছাড়া অন্য করো ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাঁদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাঁদেরকে ‘উহ্’ শব্দটিও বলো না, তাঁদেরকে ধমক দিও না এবং তাঁদের সঙ্গে আদবের সঙ্গে কথা বলিও। তাঁদের সামনে করুণভাবে বিনয়ের সঙ্গে নত থাকবে। আর এইরূপ দোয়া করতে থাকবে, হে আমার পরওয়ারদেগার, তাঁদের উভয়ের প্রতি দয়া করুন যেইরূপ তাঁরা আমাকে লালন-পালন করেছেন শৈশবকালে।” (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-২৩, ২৪)
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। আর সে বেহেশত অর্জন করার পূর্বশর্ত হচ্ছে তাঁদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, নরম ভাষায় কথা বলা, সম্মানের চোখে দেখা।” রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, “আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে।” (তিরমিযি, হাদিস নং-১৮৯৯)
অন্যদিকে সনাতন ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে, “পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহী পরমং তপঃ। পিতরী প্রিতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা। অর্থাৎ ‘পিতাই ধর্ম, পিতাই স্বর্গ, পিতাই পরম তপস্যা। পিতাকে খুশি করলে সকল দেবতা খুশি হন।”
বাবা ছাড়া সন্তানের বাঁচার লড়াইটা বড় কঠিন। তাই বাবাকে সুখে-দুঃখে সব সময় মনে পড়ে। তাঁর পরশ ও সঙ্গ লাভের প্রত্যাশা জাগে। যার বাবা নেই, তার মাথার উপরে ছাতাও নেই, ছাদও নেই। সে সবচে’ নিরাপত্তাহীন অসহায় সন্তান।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের ‘কাটে না সময় যখন’ গানে বাবার জন্য নিরাপত্তাহীন ও অসহায় সন্তানের বাবার আশ্রয়ের আকুতিই ফুটে উঠেছে, ‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতে/ বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না/ জানালার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা/ মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না/ আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়…।’
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।