একটি ত্রিভুজ প্রেমের দম্পতির জবানবন্দী

Spread the love

দ্যুতিময় বুলবুল
অষ্টম পর্ব

সোমেনের সবিস্তার দীর্ঘ বক্তব্য শোনার পর, আমি পুরোপুরি নির্বাক, নিরব, নিস্তব্ধ। হঠাৎ যেন ভূমিকম্পের এক তীব্র ঝাঁকুনিতে আমার পুরো পৃথিবী আজ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। ২১ বছরের প্রেম, দাম্পত্য ও সংসার আজ কঠিন প্রশ্নের মুখে। হায়, ঈশ্বর! আমাকে পথ দেখাও। এই কি ভালোবাসার যোগ্য অধিকার ও সম্মান?

এতদিনের প্রেম-প্রীতি, হাসি-কান্না, মান-অভিমান, ত্যাগ-তিতিক্ষা, স্বপ্ন-সাধনা সবই যেন আজ ব্যর্থ ও মূল্যহীন! এই অসহ্য অন্তর্জ্বালার উপশম কোথায়? এতো দিনের প্রেম-সম্পর্ক, দাম্পত্য-সংসার, সবই কি মিথ্যা, অর্থহীন?

সোমেন বলছে, সে শ্যাম ও কূল দুটোই রক্ষা করতে চায়। সে শ্যামলীকেও চায়, কল্যাণীকেও চায়। কিন্তু আজকের এই দিনে সেটা কিভাবে সম্ভব? এটা তো আদিম, বৈদিক বা পৌরাণিক যুগ নয়। নিদেনপক্ষে সামন্ত যুগের পশ্চাৎপদ মানব সমাজও নয়। পুরাপুরি আধুনিক যুগের আলোকিত ও বিকশিত সমাজ । এই সময় একাধিক বিয়ে, একাধিক স্ত্রী বা একাধিক স্বামী গ্রহণ এবং দাসী-বান্দীর জীবনযাপন অযৌক্তিক ও অসম্মানজনক। কোনো আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীন ও ব্যক্তিত্ববান শিক্ষিত এবং প্রগতিশীল আধুনিক নারী এটা মানতে পারে না।

নারী এখন আর পুরুষের হাতের পুতুল নয়, বিশেষ করে আধুনিক, শিক্ষিত ও প্রগতিশীল নারী ‘পতি দেবতা’ বা ‘পতি পরমেশ্বর’ ভেবে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অসম্মানীত হতে চায় না। তাদের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ যথেষ্ট প্রখর ও যুক্তিসঙ্গত। বিবেক, ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ববোধ তাদের অনেক উপরে। একজন শিক্ষিত, আধুনিক ও প্রগতিশীল নারী এখন ন্যায়সঙ্গত অধিকার সচেতন, পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তারা পুরুষের সঙ্গে সমতা ও সমঅধিকারে বিশ্বাস করে।

আর True & Profound Love যেখানে, সেখানে অবিশ্বাস, অসমতা, অন্যায্যতা, গোপনীয়তা এবং অসম্মান ও অশ্রদ্ধা থাকতে পারে না। পরস্পরের প্রতি আস্থা –বিশ্বাস, সম্মান-শ্রদ্ধা, প্রেম-প্রীতি, ভক্তি-ভালোবাসা সবই থাকবে অবাধ, স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট। কেউ কাউকে অবহেলা করবে না, কারো দুর্বলতার সুযোগ নেবে না, কাউকে কষ্ট দেবে না, অসম্মান করবে না, কিছু গোপন করবে না। দু’জনের সম্পর্ক হবে খোলামেলা, উদার, স্বাধীন-মুক্ত বাতাসে অক্সিজেন গ্রহণের মতো।

কারণ, একটি সুখী এবং পরিপূর্ণ বিবাহিত জীবনের ভিত্তি হলো শারীরিক, মানসিক এবং আত্মীকভাবে স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে ঐক্য সংহতি, ঘনিষ্ঠতা সমঝোতা এবং ভালোলাগা ও ভালোবাসার উপস্থিতি। বিবাহিত জীবন হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী দু’জন দু’জনের শুধু জীবনসঙ্গী নয়, আত্মার আত্মীয়-জীবন মরণের সঙ্গী। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন হতে হবে সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলময়। আর তাদের সম্পর্ক হবে হাত ও চোখের মতো। যদি হাত ব্যথা পায় তাহলে চোখ কাঁদে, যদি চোখ কাঁদে তাহলে হাত অশ্রু মুছে দেয়।

সে জন্যই তো অগ্নিদেবকে ঐশ্বরিক সাক্ষী রেখে আমরা সামবেদীয় বৈবাহিক মাঙ্গলিক মন্ত্রপাঠ করেছিলাম, “যদেতৎ হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।।” অর্থাৎ তোমার হৃদয়, তা আমার হউক এবং এই যে আমার হৃদয়, তা তোমার হউক। সত্যিই কি আমাদের পরস্পরের হৃদয় বিনিময় হয়েছে? যদি হতো তাহলে হয়ত আজকের এই দিনটি দেখতে হতো না।

সন্ধ্যা থেকে সারারাত পেরিয়ে গেল, সবচেয়ে কাছের মানুষের সঙ্গে আছি-তবুও যেন মনে হচ্ছে- এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচে’ অসহায় ও নিঃসঙ্গ আমি। বড় একা। চোখে ঘুম নেই। নেই সুখ স্বপ্নের আশ্বাস। আছে দীর্ঘশ্বাস ও অবিশ্বাস! বিছানায় দু’জনেই আছি, শুয়ে-বসে পাশাপাশি, তবুও মনে হচ্ছে একটি খালি বিছানায় দু’টি অচেনা মানুষ, পরস্পরের দিকে নিরব-নির্বাক-নিস্তব্ধ তাকিয়ে আছি। জীবনানন্দের ভাষায়-
“—– সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন/ সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;/ পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন/ তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;/ সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;/ থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”

আমাদের একমাত্র বন্ধন যে প্রেম, সেখানে অবিশ্বাসের হাতছানি, অশ্রদ্ধা ও অসম্মানের নগ্ন পরশ। আমরা কি তবে সত্যিই দূরে সরে গেছি? আমরা কি এখন চিন্তা-চেতনায় আলাদা ব্যক্তি, পৃথক সত্তা? আজ এই রাতে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম, অবাক বিস্ময়ে।

যে স্বপ্ন নিয়ে প্রেম ও বিয়ের পর-সংসার পেতেছিলাম, সেই স্বপ্ন আজ ভেঙে গেছে। এই জগৎ-সংসার, প্রেম-ভালোবাসা সবই মিথ্যা মনে হচ্ছে। তাই ইচ্ছা করছে এই ভবলীলা সাঙ্গ করি। কিন্তু কীভাবে সম্ভব? আমার দুটি সন্তান আছে, তাদের কী হবে? তাদের জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে, লড়তে হবে। দাম্পত্য এমনই এক বিস্ময়কর সম্পর্ক, যেখানে শূন্যতা ও পূর্ণতার বাস পাশাপাশি। কখন যে কী হয়- মানব চরিত্র, বুঝা বড় দায়।

আজ আমার চোখ খুলে গেল- বুঝলাম, পৃথিবীতে কেউ কারো নয়! সবই স্বপ্নের ফানুস। ভালোবাসা বলতে কিছু নাই এই পৃথিবীতে, ভালোবাসা একটা মরীচিকা মাত্র। অথচ ফার্সি কবি জালাল উদ্দিন রুমি বলেছেন, “প্রেমই মুক্তি, প্রেমই শক্তি, প্রেমই পরিবর্তনের গুপ্তশক্তি, প্রেমই দিব্য সৌন্দর্যের দর্পন স্বরূপ।” কিন্তু তার প্রমাণ তো পাচ্ছি না!

তাহলে শরৎচন্দ্রের কথাই সত্য? “বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না; ইহা দুরেও ঠেলিয়া দেয়”। তাই জন কিটসের ভাষায় বলতে হয়, “যে ভালোবাসা পেল না, যে কাউকে ভালোবাসতে পারল না, সংসারে তার মতো হতভাগা কেউ নেই।” মনে হচ্ছে, life is nothing, but all empty dream.

দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।